মতামত

তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: রাজনীতিতে কি পরিবর্তনের হাওয়া?

দীর্ঘ ১৭ বছর বিদেশে অবস্থানের পর আজ দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে তিনি নিজেই ঘোষণা দেন যে, ২৫ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশে ফিরবেন। তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে বিশাল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। তার আগমনের অপেক্ষায় দেশের কোটি মানুষ ভাবছেন, দ্রুত ছেলে এসে হাজির হোক অসুস্থ জননীর শিয়রের পাশে এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের পাশে।

আমরা জানি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কোনো দেশের রাজনীতিতে কখনো কখনো বিশেষ ব্যক্তি বা কারও একটি দিন, একটি ফেরার তারিখ শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় আটকে থাকে না। তা হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক ক্ষণ ও প্রতীকের ভাষা। আগামীর একজন সম্ভাব্য রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানের ২৫ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার ঘোষণাও তেমনই এক বিশেষ মুহূর্ত জন্মানোর জন্য অপেক্ষা করছে। এই ফেরা একজন রাজনৈতিক নেতার প্রত্যাবর্তনের সাথে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি, বিতর্ক, প্রত্যাশা ও আবেগের এক জটিল মোড়। এই ফেরা বিএনপির দলীয় রাজনীতির নতুন অধ্যায় এবং অসুস্থ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পাশে সন্তানের দাঁড়ানোর ঐতিহাসিক মুহূর্ত হতে যাচ্ছে।

তারেক রহমানের অসুস্থ মায়ের শিয়রের পাশে সন্তানের উপস্থিতি যেমন মানসিক শক্তি জোগাতে যাচ্ছে তেমনি রাজনীতিতেও নেতৃত্বের শারীরিক উপস্থিতি কর্মী-সমর্থকদের জন্য সাহস ও আস্থার উৎস। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতা ও দীর্ঘ রাজনৈতিক নিষ্ক্রিতার প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরা দলটির জন্য আবেগঘন এক বার্তা বহন করছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে তার অতীতের তারুণ্যদীপ্ত নেতৃত্ব আবার নতুন পরিপক্ব উদ্দীপনায় দৃশ্যমান হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে দলটি আন্দোলনের ভাষায় উত্তাপ তৈরি করতে পারলেও কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ফল অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা যদি পুরোনো কৌশল আর অতীতের প্রতিহিংসার পুনরাবৃত্তি হয়, তবে তা হবে হতাশার আরেক অধ্যায়। কিন্তু যদি তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, সাংগঠনিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সামনে আনতে পারেন, তবে এই প্রত্যাবর্তন নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে।

তবে এই প্রত্যাবর্তন আবেগের পাশাপাশি বাস্তবতার কঠিন প্রশ্নও সামনে আনে। দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকা একজন নেতার রাজনৈতিক দায় কেবল স্লোগানে মেটানো যায় না। রাজনীতি এখন আর কেবল বক্তৃতা কিংবা ভার্চুয়াল নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ নয়। মাঠের বাস্তবতা, সাংগঠনিক ভাঙন, তরুণ নেতৃত্বের প্রত্যাশা সবকিছুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে সরাসরি। বুঝতে হবে মা এবং দেশমাতৃকার শিয়রের পাশে দাঁড়ানো মানে শুধু পাশে থাকা নয়, সময়ের ভার কাঁধে নেওয়াও।

এখানে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, এই আবেগ রাজনৈতিক পরিপক্বতায় রূপ দেওয়া। দীর্ঘদিন ধরে দলটি আন্দোলনের ভাষায় উত্তাপ তৈরি করতে পারলেও কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ফল অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা যদি পুরোনো কৌশল আর অতীতের প্রতিহিংসার পুনরাবৃত্তি হয়, তবে তা হবে হতাশার আরেক অধ্যায়। কিন্তু যদি তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, সাংগঠনিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সামনে আনতে পারেন, তবে এই প্রত্যাবর্তন নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে।

রাষ্ট্রের জন্যও এটি একটি পরীক্ষার মুহূর্ত। ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতার প্রত্যাবর্তনকে কীভাবে দেখা হবে প্রতিহিংসার চোখে, না গণতান্ত্রিক সহনশীলতার মানদণ্ডে তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেবে। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই যে, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিও আইনের শাসনের ভেতরে জায়গা পায়।

তবে রাজনীতিতে আবেগই শেষ কথা নয়। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকা একজন নেতার সামনে বাস্তবতার প্রশ্নগুলো কঠিন ও নির্মম। দলীয় সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ, তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক ভাষা এবং পরিবর্তিত বৈশ্বিক রাজনীতির অভিঘাত সবকিছুর মুখোমুখি হতে হবে সরাসরি। শুধু ভার্চুয়াল বক্তব্য বা প্রতীকী উপস্থিতি দিয়ে এখন আর রাজনীতির মাঠ দখল করা যায় না। এজন্য প্রয়োজন দৃশ্যমান নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত।

তারেক রহমানের ফেরাকে ঘিরে অতীতের নানান বিতর্ক, সমালোচনাও নতুন করে সামনে আসবে এটাই স্বাভাবিক। আশা করা যায় তার এই প্রত্যাবর্তন অতীতের রাজনীতির পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না। সামনে অনেক আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণ করবে তা নতুন কল্যাণকর দিকনির্দেশনা দেবে। বিএনপির দীর্ঘদিনের আন্দোলননির্ভর রাজনীতি যদি এবার গঠনমূলক কর্মসূচি, সাংগঠনিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক সহনশীলতায় রূপ নেয় তবেই এ ফেরা রাজনৈতিকভাবে অর্থবহ হবে এবং সামাজিকভাবে সাধারণ মানুষ অনেকটা আশাবাদী হবে।রাষ্ট্রের জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতার প্রত্যাবর্তন কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, আইনের শাসন, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার মানদণ্ডে তা দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রের প্রতিফলন কীভাবে ঘটাবে এবং প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি না হয়ে একটি ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের শক্তি বাড়াবে। তার জন্য নতুন আর্থ-সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক নতুন নতুন পলিসি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে থেকেও তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতিতে দৃশ্যমান ছিলেন। তবে বাস্তবতা হলো, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের রাজনীতি কেবল ভার্চুয়াল নেতৃত্বে এগোয় না। মাঠের রাজনীতি, জনসম্পৃক্ততা, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা সবই সরাসরি উপস্থিতি দাবি করে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা তাই বিএনপির জন্য একটি মনোবল জাগানিয়া ঘটনা হলেও, এর রাজনৈতিক তাৎপর্য আরও গভীরে এটি নির্বাচনকে ‘পরীক্ষামূলক অংশগ্রহণ’ থেকে বের করে আনার এক ইঙ্গিত। তিনি লন্ডনের এক বক্তৃতায় বলেন, এবারের নির্বাচন কোনো এক্সপেরিমেন্ট নয়। এই প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। তা হচ্ছে, এবারের নির্বাচন কোনা এক্সপেরিমেন্ট নয়। এটি আমাদের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বাস্তব পরীক্ষা।

এছাড়া বলা যায়, তারেক রহমানের লন্ডন বক্তৃতা এই উচ্চারণ এটি একটি গণতান্ত্রিক দাবি। তার দেশে ফেরার ঘোষণা সেই দাবি নতুন মাত্রা দিয়েছে। এখন সামনে দেখতে হবে রাষ্ট্র, সরকার ও বিরোধী দল ও ভোটাররা কি এই নির্বাচন সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আস্থার পরীক্ষায় রূপ দিতে পারবে? এর উত্তরই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে কতটা এগোতে পারল।

তারেক রহমানের লন্ডন বক্তৃতায় স্পষ্ট ছিল তিনটি ইঙ্গিত। প্রথমত, অতীতের বর্জন, অর্ধ-অংশগ্রহণ কিংবা পরীক্ষামূলক রাজনৈতিক কৌশল আর নয়। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকে ‘ম্যানেজড ইভেন্ট’ না ভেবে জনগণের প্রকৃত রায় নির্ধারণের প্রক্রিয়া হিসেবে ফিরিয়ে আনার দাবি। তৃতীয়ত, বিএনপি আর কেবল আন্দোলনের রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই মুহূর্তে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতিই হবে দলটির মূল লক্ষ্য। এই বক্তব্য তার দেশে ফেরার ঘোষণার পর আরও বাস্তব ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠলেও দেশের কোটি কোটি মানুষ অনেকটা ইতিবাচক ও আশাবাদী হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।

গত কয়েকটি নির্বাচন ঘিরে বিরোধী দলের অনাস্থা, বর্জন কিংবা সীমিত অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একতরফা নির্বাচন যেমন- গণতান্ত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করে, তেমনি বিরোধী রাজনীতির অনুপস্থিতিও ভোটের অর্থকে ফাঁপা করে তোলে। এ বাস্তবতায় রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা বহন করে এবারের নির্বাচন আর পরীক্ষাগারে চালানো যাবে না। এটি হতে হবে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মঞ্চ। তবে এখানে দায় শুধু একটি দলের থাকবে না। রাষ্ট্র ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণে মুখ্য। নির্বাচন যদি সত্যিই ‘এক্সপেরিমেন্ট’ না হয়, তবে তা হতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও আস্থাভিত্তিক।

তবে শেষ পর্যন্ত একজন সুবোধ ছেলে আপন জননীর সেবায় এসে দাঁড়াক অসুস্থ দেশনেত্রী মা খালেদা জিয়ার শিয়রে, পাশাপাশি দাঁড়াক বাংলাদেশের জনগণের পাশে। এই আশা তার সব শুভানুধ্যায়ীর। কোটি মানুষের এই আশা ও আহ্বান কেবল পারিবারিক বা দলীয় আবেগের বিষয় হিসেবে ভাবা ঠিক হবে না। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি তার জন্য একটি বড় দায়িত্বের ডাক। তারেক রহমানের সামনে এখন বিরাট সুযোগ এসেছে নিজেকে কেবল উত্তরাধিকারী হিসেবে না ভেবে সময়োপযোগী, দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালানোর ব্রত নেওয়ার। সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারলেই ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং একটি ফলপ্রসূ ও আলোচিত আগমন হয়েই বাংলাদেশের রাজনীতির পাতায় ঠাঁই করে নেবে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এএসএম