দেশজুড়ে

দখলে বিলীন হচ্ছে পাখিবন্ধুর অভয়াশ্রম

বিয়ে করেননি, নেই সন্তান-সন্ততিও। সব স্নেহ ও প্রীতি দিয়ে সন্তানের মত পাখ-পাখালিকে ভালোবাসতেন পাবনার বেড়া উপজেলার আকাশ কলি দাস। এ প্রীতির জায়গা থেকে দীর্ঘ ছয় দশক ধরে ৬ বিঘার বসতি বাড়ির ওপর গড়ে তোলেন পাখির অভয়াশ্রম। পান জাতীয়সহ বিভিন্ন সম্মাননা ও পাখিবন্ধু খ্যাতি।

তবে সম্প্রতি দখলদারদের থাবায় এটি ধ্বংসের মুখে। জালিয়াতির মাধ্যমে দান স্বত্ব ও ক্রয়সূত্রে মালিকানা দাবি করে তিন দখলদার কাটছেন অভয়াশ্রমের গাছ গাছালি। বাড়িঘর তুলে তাড়িয়ে দিচ্ছেন পাখ-পাখালিদের। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়ানো এ অভয়াশ্রম ও আকাশ কলি দাসের সম্পদ রক্ষার দাবি তুলেছে স্থানীয়রা।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ইলিয়াস হোসাইন নামের এক সমাজকর্মী বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পাবনা জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।

লিখিত অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রাণ প্রকৃতির জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন আকাশ কলি দাস। গরুর গলায় দড়ি বাধতেন না তিনি। তার ধারণা ছিল এর মালিক তিনি নন। কুকুর বিড়ালসহ বিভিন্ন বিপদগ্রস্ত প্রাণীকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে খাবার দেওয়া ও যত্ন নিতেন তিনি। পাখ-পাখালিদের জন্য নিজের বাড়িকে করেন অভয়াশ্রম। জঙ্গলঘেরা বাড়িটি সবসময় মুখর থাকতো পাখিদের কলতানে। গাছে গাছে বসতি গড়া শত শত পাখির হৈ হুল্লোরে জুড়াতো নয়ন মন।

চিরকুমার আকাশকলি স্থানীয়ভাবে ‘পাখিবন্ধু’ বলে পরিচিত ছিলেন। পাখিই ছিল তার স্বজন ও পরিবারের সদস্য। পাখিদের কোনো ক্ষতি করতে দিতেন না। পাহারা দিয়ে রাখতেন, দিতেন পর্যাপ্ত খাবার। শীত মৌসুমে দেশি পাখির সঙ্গে আশ্রয় নিতে পরিযায়ী পাখিও। ঝাঁক বেঁধে আসত দেশি বক, কানি বক, পানকৌড়ি, শামুকখোল, ঘুঘু, দোয়েল, শালিক, ছোট সরালি, বড় সরালি, খঞ্জনা ও পাতিহাঁস। আকাশকলির বাড়িতে পাখি থাকার কথা ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে দেশে বিদেশে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িটিতে ৫০ বছর ধরে লাগিয়েছেন বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় গাছ। নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার পেয়ে পাখির সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মৎস্য অধিদপ্তরের ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (ডব্লিউবিআরপি) বাড়িটিকে ‘পাখি অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে। এমন মহৎ কাজের জন্য আকাশকলি দাস ২০২৪ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সরকারের অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজার্ভেশন-২০২৪’ সম্মাননা ও ডেইলি স্টার সম্মাননাসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। নিজের অবর্তমানে তার সম্পত্তি ও প্রায় ছয় দশকের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা অভয়াশ্রমমের মালিকানা বা দখল নিয়ে কি কি নাটকীয়তা দেখা দিতে পারে সে আশঙ্কার কথা বলে গিয়েছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর চারমাস না পেরোতে তার আশঙ্কাই নির্মম বাস্তবতা হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি দান স্বত্ব ও ক্রয়সূত্রে তিন মালিকের উদ্ভব ঘটেছে অভয়াশ্রমে।

স্থানীয়রা জানান, মৃত্যুর কয়েকমাস আগে আকাশকলি দাসের মায়ের খালাতো ভাইয়ের ছেলে পরিচয়ে অসিত ঘোষ আকাশকলি দাশকে সুশ্রুষা ও উন্নত চিকিৎসার কথা বলে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। এরপর আকাশ কলির দীর্ঘদিনের পুরোনো রাখাল ও দেখভালে নিয়োজিতদের ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় সেসময় আকাশকলি দাস স্মৃতিবিভ্রমে ভুগতেন। কাউকে ভালো করে চিনতেও পারতেন না। ১৮ আগস্ট আকাশকলি অসিতের বাড়িতেই মারা যান। এরপর বাড়ি বিক্রি ও সকল সম্পত্তি অসিত ও অসীমকে দান করে গেছেন বলে দাবি করেন অসিত।

এদিকে মৃত্যুর মাত্র ১৭ দিন আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আকাশকলি অভয়াশ্রম সংরক্ষণের আজন্মের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিক্রি করেছেন দাবি করলেও রেজিস্ট্রির সময় এলাকার জনপ্রতিনিধি বা প্রতিবেশী কাউকে জানানো হয়নি। সাক্ষীও রাখা হয়নি। নেই কোনো ছবি, ভিডিও বা প্রমাণ। এলাকাবাসীর সন্দেহ পরিকল্পিতভাবে অসিত ঘোষ সাব রেজিস্ট্রি অফিসকে ম্যানেজ করে ভুয়া দলিল করে অভয়াশ্রমের সম্পত্তি আত্মসাৎ ও বিক্রি করেছেন।

আকাশ কলি দাসের প্রতিবেশী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রুবেল মিয়া বলেন, আকাশ কলি দাদু এতোটাই প্রাণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন যে কখনো হাস মুরগিও বিক্রি করেননি। সেখানে তার সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন পাখিদের আবাসস্থল তিনি বিক্রি করে দেবেন এটা কেউই বিশ্বাস করে না। জীবনের শেষ প্রান্তে স্বাভাবিক জ্ঞানশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন কী করে জমি রেজিস্ট্রি হলো সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।

আকাশকলির দীর্ঘদিনের কর্মচারী জাহিদুল বলেন, সাত আট মাস আগে দাদাকে অসিত বাবু নিয়ে যান। তিনি দাদার চিকিৎসাও করিয়েছেন। কিন্তু জমি কবে কখন দাদা দান ও বিক্রি করেছেন সেটি তিনি কাউকে বলেননি।

আকাশকলি দাসের ভারতে থাকা বোন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দাদা কখনো তার অভয়াশ্রম পশু-পাখি ছেড়ে যেতেন না। তাকে চিকিৎসার জন্যও আমরা নিজেদের কাছে আনতে পারিনি। রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য ভিসা জটিলতায় শেষ সময়ে তার কাছেও যেতে পারিনি। এ সময় অসিত বাবু দাদার চিকিৎসা ও সেবা করেছেন। তার জন্য কৃতজ্ঞতা। কিন্তু দাদার অভয়াশ্রম কখন কবে তাকে দিলেন, বিক্রি হলো এসবের কিছুই আমরা জানি না। তিনি ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যা গড়েছেন হঠাৎ সিদ্ধান্তে সেটি বিক্রি করবেন এমন মানুষ তিনি নন।

বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের পরিবারের দাবি, বিষয়টি তদন্ত করে অভয়াশ্রম রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া হোক।

অভয়াশ্রমের মালিকানা প্রাপ্তির বিষয়ে অসিত ঘোষ বলেন, আকাশকলি দাসের অনেক টাকা দেনা ছিল। মৃত্যুর আগে তিনি সজ্ঞানে কিছু সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। বাকি সমুদয় সম্পত্তি আমাকে ও আমার ভাই অসীমকে দান করে গেছেন। আগে অভয়াশ্রমের কথা বললেও পরে তিনি সিদ্ধান্ত বদলেছেন। আমি এখন তার বন্ধকি জমিগুলো অর্থের বিনিময়ে ছাড়িয়ে নিচ্ছি।

তবে নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে অসিত ঘোষের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, হরিরামপুর মৌজায় বিভিন্ন খতিয়ানে আকাশকলি দাসের প্রায় ৪০ বিঘার মতো জমি ছিল। তার মধ্যে ৮ বিঘা ২ শতাংশ জমি চলতি বছর মালিকানা বদল হয়েছে। বাকি জমি এখনো আকাশকলি দাসের নামে রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভূমি অফিসের একটি সূত্র জানায়, অসিত ও অসীম ঘোষ আকাশকলি দাসের বাকি সম্পত্তিও জাল কাগজ করে আত্মসাতের চেষ্টা করছেন।

বেড়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী বলেন, কমিশন পদ্ধতিতে অসিত দাসের বাড়িতে গিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে। তিনি নিজ ইচ্ছায় জমি হস্তান্তর করছেন। আমি নিজে জমিদাতার সাক্ষ্য নিয়েছি।

একজন মুমূর্ষু রোগী তার শেষ ইচ্ছা পরিবর্তন করে অভয়াশ্রম বিক্রি করলেন, সে ঘোষণার কোনো ছবি, ভিডিও বা অন্য কোনো প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, আইনগতভাবে সেগুলোর কোনো প্রয়োজন না থাকায় রাখা হয়নি।

এদিকে আকাশ কলি দাসের এ অভয়াশ্রম ধ্বংস রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার দাবি পরিবেশকর্মী সহ সংশ্লিষ্টদের।

এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দেওয়া ইলিয়াস হোসাইন বলেন, আকাশকলি দাস পৃথিবীর প্রাণ প্রকৃতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত অভয়াশ্রম আমাদের এলাকাকে বিশ্বেও কাছে পরিচিত করেছিল। প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। এখন হুট করেই সেটিতে মালিকানার দাবি এসেছে। অভয়াশ্রম লিখে দেবার মানুষ তিনি নন। সুতরাং এটি সন্দেহজনক। বিষয়টি তদন্তপূর্বক দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদনও জানান তিনি।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, উন্নয়নের নামে আমরা প্রতিনিয়ত গাছপালা বন উজাড় করে পাখির আবাসস্থল ধ্বংস করছি। আকাশকলি প্রকৃতিতে বৃক্ষ ও পাখির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ সংরক্ষণের মাস্টার্সের ক্লাসেও পাখিবন্ধু আকাশকলির অভয়াশ্রমকে মডেল হিসেবে পড়ানো হয়। একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের সারাজীবনের স্বপ্ন ও পরিশ্রমে গড়া অভয়াশ্রম এভাবে ধ্বংস করা হবে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমি প্রত্যাশা করবো পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে অভয়াশ্রমটি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

এ ব্যাপারে পাবনা জেলা প্রশাসক শাহেদ মোস্তফা বলেন, অভয়াশ্রমটি রক্ষায় জেলা প্রশাসনের আন্তরিক প্রচেষ্টা রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে জমি দখল করা হয়েছে কিনা জানতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। অবৈধ দখল হয়ে থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি পাখিদের আবাসভূমি রক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে।

আলমগীর হোসাইন নাবিল/আরএইচ/এএসএম