অর্থনীতি

পাচারের অর্থ উদ্ধারে তৎপরতা থাকলেও দ্রুত ফেরার আশা ক্ষীণ

অন্তর্বর্তী সরকারের ১৬ মাস। এই সময়ে কতটুকু দাঁড়ালো ভঙ্গুর ব্যাংকখাত? এমন প্রশ্ন অনেকের। আবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময় পাচার হওয়া অর্থের যেটুকু জব্দ করা গেছে তা ফেরত আনা সম্ভব কি না এ নিয়েও রয়েছে সংশয়।

অর্থনীতি বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ও টাকা পাচারের কারণে ভয়াবহ সংকটে পড়া ব্যাংকখাত খাদের কিনার থেকে কতটুকু তোলা সম্ভব যেখানে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলছেন, বিদেশ থেকে অর্থ আনতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগে, এর নিচে হয় না।

গত ১৭ ডিসেম্বর সচিবালয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে প্রশ্ন করা হয়, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে কতগুলো কেস চিহ্নিত করতে পেরেছেন? জবাবে গভর্নর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংখ্যাটা এ মুহূর্তে মনে নেই। অনেকগুলো মামলা হয়েছে।’

আরও পড়ুন:

ব্যাংক খাতে আস্থা ফেরাতে আংশিকভাবে সফল হয়েছি: গভর্নরএস আলমকে নিয়ে গভর্নর বললেন, ‘চোরের মায়ের বড় গলা’লুটপাট হলে দায় ওই ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিতে হবে: গভর্নর

মামলা থেকে অর্থ আসবে কি না বা এ ধরনের কোনো আশা পাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘আমাদের কথা বলতে হবে। বিদেশ থেকে অর্থ আনতে চার-পাঁচ বছর লাগে। এর নিচে হয় না।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যার একটি বড় অংশই বিভিন্ন উপায়ে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বিগত সময়ে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশের ভেতরে ৫৫ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সংযুক্ত এবং অবরুদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে থাকা ১০ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিসহ মোট ৬৬ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ সংযুক্ত এবং অবরুদ্ধ করা হয়েছে। সম্প্রতি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

তবে খুবই কৌশলে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে দেখা দিয়েছে নানামুখী জটিলতা। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ আদৌ দেশে ফিরবে কি না, এনিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন ও জল্পনা-কল্পনা। এসব অর্থ ফেরত এলে দেশের অর্থনীতিতে তা বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন:

অর্থপাচার: দেশে-বিদেশে ৬৬১৪৬ কোটি টাকার সম্পদ সংযুক্ত-অবরুদ্ধঅর্থপাচারের ৮৫ শতাংশই আমদানি-রপ্তানির আড়ালেঅর্ধেকের বেশি খেলাপি ঋণ ১৭ ব্যাংকে, ছয়টির অবস্থা ভয়াবহ

আর্থিক খাত বিশ্লেষকদের মতে, বিগত সময়ে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংকখাত থেকে বের করে নেওয়া হয়, যার একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমানে সেই অর্থ পাচারের প্রকৃত চিত্র ধীরে ধীরে সামনে আসছে। তবে আইনি জটিলতা ও আন্তর্জাতিক আইনগত প্রক্রিয়ার কারণে এসব সম্পদ দ্রুত দেশে ফেরত আনা সম্ভব নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে পাচার করা অর্থ ও সম্পদ ফেরত আনা সম্ভব হলেও এর জন্য কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। ফলে ব্যাংকখাতের সংকট নিরসন ও অর্থনীতিতে এর সুফল পেতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশে কার্যত ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ২৩টির খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে। অন্যদিকে ১৩টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে, ৮টি ব্যাংকের ২০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে এবং উদ্বেগজনকভাবে ১৭টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকখাতে মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এক বছর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির ইঙ্গিত।

আরও পড়ুন:

বিদেশে পাচার অর্থ ফেরাতে ব্যাংকগুলোকে নতুন নির্দেশনাপাচার হওয়া হাজার কোটি টাকার ১১টি, দুইশ কোটির ১০১টি কেস চিহ্নিতআন্তর্জাতিক সহযোগিতায় গতি পাচ্ছে পাচার অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ঋণের বিপরীতে দেশে থাকা সম্পদ বিক্রি করে অর্থ উদ্ধারের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে সে কার্যক্রমে এখনো কাঙ্ক্ষিত গতি দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকদের মতে, ভুয়া ঋণ অনুমোদন এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ ছাড়ের কারণে বিপুল খেলাপি ঋণের বিপরীতে দেশে থাকা সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত। ফলে এসব সম্পদ বিক্রি করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করা কঠিন।

তাছাড়া, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াও জটিল ও সময়সাপেক্ষ। আন্তর্জাতিক আইনগত বাধা এবং দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার কারণে ফেরত আনার হারও তুলনামূলকভাবে কম।

তবে আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে সরকারের উদ্যোগ অব্যাহত রাখা জরুরি। ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদে হলেও এর সুফল পাওয়া সম্ভব।

পাচারকারীদের সম্পদ বিক্রি করে অর্থ উদ্ধারে গতি নেই

বড় ঋণখেলাপিদের দ্রুত শনাক্ত করে দেশে থাকা তাদের সম্পদ বিক্রি করে অর্থ উদ্ধারের ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সেই উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত প্রায় ৬৬ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দ এবং অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তবে এসব সম্পদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ও বিক্রির ক্ষেত্রে নানা আইনি জটিলতা রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আগেই জানিয়েছিলেন, বড় ঋণখেলাপিদের দ্রুত চিহ্নিত করে দেশের অভ্যন্তরে থাকা তাদের সব সম্পদ উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তার কৌশল অনুযায়ী, প্রথম ধাপে দেশের ভেতরের উৎস থেকে অর্থ উদ্ধার করা হবে, এরপর বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকখাতের ওপর আস্থা ধরে রাখাই ছিল আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। আমি বলবো না যে আমরা পুরোপুরি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, তবে তা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি এবং আংশিকভাবে সফল হয়েছি। পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর ক্ষেত্রে আমরা বহুলাংশে সফল হয়েছি।

পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে জোরালো প্রচেষ্টা

নামহীন ও অস্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে বিপুল অর্থ দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এসব ঋণ পরবর্তী সময়ে পরিশোধ না হওয়ায় খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে নেওয়া উদ্যোগ সম্পর্কে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং ইতিবাচক ফলের আশা করা যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু জটিলতা ও চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে।

তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি অর্থ পাচারের বিষয়ে দেশটির এক মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, অর্থটি সরাসরি বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করেনি। বরং সাইপ্রাস হয়ে সে দেশে এসেছে, যা তাদের আইনে বৈধ হিসেবে বিবেচিত। ফলে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এ ধরনের আইনি জটিলতাই অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এগোচ্ছি এবং অধিকাংশ দেশই এ বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, দেশের অভ্যন্তরের সম্পদ উদ্ধার এবং বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কার্যক্রম চলমান। পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতির আশা করছি।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, পাচার হওয়া অর্থ যে দেশে রয়েছে সেই দেশের সরকারের সহযোগিতা ছাড়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয়। সরকার এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে।

তবে তিনি উল্লেখ করেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কারণ, অর্থ পাচার হয়েছে একাধিক দেশে, যেখানে আইন ও বিচারব্যবস্থা ভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রে মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয় এবং প্রকৃত মালিক চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া যেসব অর্থ এরইমধ্যে সেসব দেশে বিনিয়োগ হয়েছে বা একাধিকবার হাতবদল হয়েছে, সেগুলো ফেরত আনা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে।

একই ধরনের মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল বায়েস। তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে চার-পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে। স্বল্প সময়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ ফেরত আনার যে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। বরং এ ধরনের বক্তব্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে অযথা আতঙ্ক ও প্যানিক তৈরি হচ্ছে।

ড. আব্দুল বায়েস আরও বলেন, এটি অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। সম্প্রতি জানানো হয়েছে, দেশে ও দেশের বাইরে মিলিয়ে প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তবে এসব অর্থ ফেরত আনতে গেলে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। সেখানে সরকার যেমন জিততে পারে, তেমনি বিপরীত পক্ষও আইনি সুবিধা পেতে পারে। সব অর্থই যে অবৈধ, তা নয়। বাণিজ্য–সম্পর্কিত লেনদেন বিশ্লেষণ করে আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মতো অনিয়মের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে প্রতিটি লেনদেন খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত কঠিন।

ইএআর/এসএনআর/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম