‘বিয়ে’ এক দিনের অনুষ্ঠান হলেও এর প্রস্তুতি, কল্পনা আর আবেগ জড়িয়ে থাকে বহুদিন ধরে। সেই দিনের সাজ শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়; এটি একজন নারীর রুচি, আত্মপরিচয় আর অনুভূতির নীরব ভাষা। ঠিক এখানেই এসে জামদানি হয়ে ওঠে বিয়ের সাজের এক অনন্য নাম। ভারী জাঁকজমকের বাইরে গিয়ে যে শাড়ি নিঃশব্দে মন ছুঁয়ে যায়, যে বুননে লুকিয়ে থাকে ঐতিহ্য আর কোমলতা তার নামই জামদানি।
জামদানি মানেই বাঙালিয়ানার গভীর শিকড়। এই শাড়ি কোনো ট্রেন্ডের ফসল নয়; শত শত বছরের ঐতিহ্যের ধারক। হাতের নিপুণ কারুকাজে, সূতার ফাঁকে ফাঁকে যে সৌন্দর্য জন্ম নেয় তা কখনো চিৎকার করে চোখে পড়ে না, বরং ধীরে ধীরে হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। তাই বিয়ের মতো জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন দিনে অনেক কনের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠছে জামদানি।
একসময় জামদানি মানেই ছিল সাদা জমিনে হালকা নকশা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শাড়িও পেয়েছে নতুন রূপ। এখন বিয়ের জন্য তৈরি হচ্ছে ডিজাইনার জামদানি যেখানে থাকছে মেরুন, অফ-হোয়াইট, আইভরি, প্যাস্টেল পিঙ্ক, সেজ গ্রিন কিংবা সফট গোল্ডেন রঙের ব্যবহার। সূক্ষ্ম জরির কাজ, ফুল, কল্কা কিংবা জ্যামিতিক মোটিফ জামদানিকে করে তুলছে আরও রাজকীয়, কিন্তু কখনোই ভারী নয়।
জামদানির সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য এর স্বাচ্ছন্দ্য। বিয়ের দীর্ঘ আয়োজন, অতিথির ভিড়, ছবি তোলা সব কিছুর মধ্যেও এই শাড়ি কনেকে ক্লান্ত করে না। বরং শরীরের সঙ্গে সহজেই মিশে গিয়ে আলাদা এক আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। যারা বিয়ের দিনে নিজেকে স্বাভাবিক, সাবলীল আর নিজের মতো করে তুলে ধরতে চান, তাদের জন্য জামদানি যেন নিখুঁত পছন্দ।
এই শাড়ির সঙ্গে সাজও হয় অন্যরকম। অতিরিক্ত গয়নার প্রয়োজন পড়ে না হালকা সোনার গয়না, কানের দুল, একটি নাকফুল বা চোকারই যথেষ্ট। খোঁপায় গাঁদা কিংবা রজনীগন্ধা, হাতে আলতা সব মিলিয়ে জামদানির সঙ্গে বিয়ের সাজ হয়ে ওঠে সংযত অথচ গভীরভাবে আকর্ষণীয়। এখানে সৌন্দর্য আসে দেখানোর জন্য নয়, অনুভব করার জন্য।
জামদানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাসও। এর জন্ম ও বিকাশ হয়েছিল ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে। একসময় এই শাড়ি ছিল রাজপরিবারের গর্ব, অভিজাতদের পরিচয়। আজও সেই আভিজাত্য রয়ে গেছে, শুধু বদলেছে তার প্রকাশভঙ্গি। আধুনিক কনে এখন ঐতিহ্যকে নতুনভাবে ধারণ করছেন, আর সেই পথের অন্যতম নাম জামদানি।
দামের দিক থেকেও জামদানির বৈচিত্র্য বিস্তৃত। সূতার কাউন্ট, নকশা আর বুননের জটিলতার ওপর নির্ভর করে এর মূল্য হতে পারে সাধারণের নাগালের মধ্যে, আবার হতে পারে সংগ্রহযোগ্য শিল্পকর্মের মতো মূল্যবান। কিন্তু যেকোনো জামদানির মধ্যেই থাকে শ্রম, সময় আর ভালোবাসার ছাপ; যা কোনো মেশিনে তৈরি শাড়িতে পাওয়া যায় না।
জামদানিতে বিয়ের সাজ মানে কেবল একটি শাড়ি বেছে নেওয়া নয়; এটি একটি দর্শন বেছে নেওয়া। যেখানে সৌন্দর্য আসে নীরবতায়, আভিজাত্য আসে সংযমে, আর রাজকীয়তা প্রকাশ পায় আত্মবিশ্বাসে। শাড়ির প্রতিটি বুননে তখন শুধু সুতা নয়; জড়িয়ে থাকে স্বপ্ন, শিকড় আর আগামী জীবনের জন্য এক শান্ত, মধুর প্রত্যাশা।
জেএস/