শিক্ষা

শিক্ষার প্রসার-টেকসই উন্নয়ন ঘটে খালেদা জিয়ার আমলে

শিক্ষাক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত বেগম খালেদা জিয়া নতুন মাত্রা এনেছিলেন। তার শাসনামলে বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস করা হয়। ছাত্রীদের মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারিগরি শিক্ষার প্রসার, শিক্ষাকে জীবনমুখী ও কর্মমুখী করে তোলার পাশাপাশি নকলমুক্ত পরীক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলায় তার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। এছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছরও করা হয় বিএনপি শাসনামলেই।

দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের দুই বছর পর ১৯৯৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে। একই বছর দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষালাভে আগ্রহী করতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার একই বছর ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচি চালু করে।

২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর ২০০৩ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন করেন তিনি। এতে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাপনা আরও একধাপ এগিয়ে যায়।

প্রাথমিক শিক্ষায় বৃত্তি ও উপবৃত্তিও চালু হয় ২০০৩ সালে। বিএনপির শাসনামলে প্রাথমিক শিক্ষায় ৭৮ লাখ শিশু ১০০ টাকা হারে বৃত্তি পেয়েছিল। খালেদা জিয়া ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালীন প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি হার উল্লেখযোগ্য ও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়। এ সময়ে ভর্তির হার ৯৭ শতাংশে উন্নীত হয়।

মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে খালেদা জিয়া১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকার বিভিন্ন মেয়াদে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ সময় ইবতেদায়ি মাদরাসাকে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমপর্যায়ে উন্নীতকরণ ও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া শুরু হয়। বিএনপি শাসনামলেই ২০০৩ সাল থেকে সরকার ইবতেদায়ি মাদরাসায় ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে আসছে।

বিএনপি সরকার মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য গাজীপুরে মাদরাসা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। ২০০২ সালে গঠিত মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, বিএনপি সরকারই ২০০৬ সালে প্রথম ফাজিলকে স্নাতক ও কামিলকে মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করেছিল।

খালেদা জিয়া সরকারের আমলেই একটি অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদে আইন পাস হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে বাংলাদেশে আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

একই বছরে খালেদা জিয়া সরকার কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিসকে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজের সমমানের মাস্টার্স ডিগ্রির মান দিয়ে ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি পরিপত্র জারি করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান দেয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাউচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রবর্তন করেন। এর মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পঠন-পাঠন শুরু করেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার বিস্তারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

শিক্ষায় দূরশিক্ষণ পদ্ধতি চালুকর্মজীবী মানুষ, যাদের কর্মস্থলে দীর্ঘকাল উপস্থিত থেকে সনাতন পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ সম্ভব নয়, যেসব বয়স্ক মানুষ যথাসময়ে নানা কারণে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি এবং বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য শিক্ষায় দূরশিক্ষণ পদ্ধতির লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) প্রতিষ্ঠা করেন। দূরশিক্ষার মাধ্যমে সমগ্র মানুষকে অতি স্বল্প সময়ে কর্মক্ষম মানব সম্পদে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যেই এ উদ্যোগ।

শিক্ষার সুযোগ গ্রহণে অসমর্থ বিশাল গ্রামীণ যুবক ও নারী সম্প্রদায়ের সামনে বাউবি শিক্ষা কর্মসূচি এক বিস্তৃত অঙ্গন উন্মোচন করে দিয়েছে। ফলে তারা স্ব-কর্ম দ্বারা যেমনি স্বাবলম্বী হচ্ছে তেমনি এ দেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাস্বৈরাচার এরশাদের পতনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন শেষে এককভাবে নির্বাচনে জিতে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার। বিএনপির শাসনামলেই ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতক পর্যায়ে বাংলাদেশের মোট শিক্ষার্থীর ৪৮ শতাংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বর্তমানে অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ২৭০০ এবং ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা২০০১ সালে বিএনপি সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার খাতের গুরুত্ব তীব্রভাবে অনুভব করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি সরকার তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গঠনের মাধ্যমে এ খাতকে জাতীয় উন্নতিতে সম্পৃক্ত করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রযুক্তি হস্তান্তর, নব নব প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং এগুলোকে ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিএনপি শাসনামলে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া দেশের বড় চারটি বিআইটিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়।

নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার১৯৯১-৯৬ শাসনামলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার নারী শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। প্রথমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং পরবর্তীকালে ডিগ্রি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করে দেওয়া হয়। মেয়ে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধ করতে শিক্ষা উপবৃত্তিও চালু করা হয়। দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার জন্য তার সরকার ‘শিক্ষার জন্য খাদ্য’ নামে এক বৃহৎ কর্মসূচিও চালু করেন।

শিক্ষাবান্ধব খালেদা জিয়া সরকারের নীতির কারণে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ে ছেলে ও মেয়েদের অনুপাত ৫২ : ৪৮-এ উন্নীত হয়। ২০০৬ সাল নাগাদ তা ৫০ : ৫০ হয়ে যায়।

খালেদা জিয়ার সময়েই মেয়েদের জন্য দুটি নতুন ক্যাডেট কলেজ ও তিনটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়। নারীর ক্ষমতায়ন ও সংসদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণও করা হয়।

এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা২০০১ সালে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর নারীদের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এশিয়া ও বিশ্বে টেকসই অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের জন্য দক্ষ ও পেশাদার সেবাভিত্তিক নারী নেতা সৃষ্টির লক্ষ্যে চট্টগ্রামে নারীদের জন্য ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বিশেষত এশিয়ান সমাজে পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর নারীদের জন্য শিক্ষার অবারিত সুযোগ সৃষ্টির এক অনন্য প্রয়াস। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের ১৬টি দেশের ৫০১ জন ছাত্রী লেখাপড়া করছে। ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’-এ প্রায় ৭০ শতাংশ বাংলাদেশি এবং বিদেশি শিক্ষার্থীরা বিনা খরচে পড়াশোনা করছে।

নকল প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টানানা প্রতিবন্ধকতার ভেতরেও বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে কাজ করেছেন। পাশাপাশি সব পাবলিক পরীক্ষায় নকলমুক্ত পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করে নকল প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশেষত নকল প্রতিরোধে তৎকালীন জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত এক নাম। তার হাত ধরে নকলের লাগাম টেনে ধরার সূচনা হয়।

জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনবাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে সাতটি শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষা কমিটি গঠিত হয়েছে। ১৯৯১-৯৬ সালে এবং পুনরায় ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বেশকিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার সুফল দেশবাসী পাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি সরকার ২০০২ ও ২০০৩ সালে দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সমস্যাবলি চিহ্নিত করে এর উন্নতিকল্পে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল।

কৃষি শিক্ষার প্রসার১৯৯১-৯৬ শাসনামলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারও কৃষি শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে কোর্সভিত্তিক এমএস ও পিএইচডি প্রোগ্রাম নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে। ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ইপসা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৯৮ সালের ২২ নভেম্বর ইপসা পুনর্গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। বর্তমানে তিনি ইউজিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। অধ্যাপক ফায়েজ জাগো নিউজকে বলেন, দুই মেয়াদেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শিক্ষার উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছেন। ১৯৯১-৯৬ শাসনামলে তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিবিড়ভাবে কাজ করেন। গণমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন। বৃত্তি চালু, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এগুলো প্রাথমিক শিক্ষায় এবং সাক্ষরতার হার বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

অধ্যাপক ফায়েজ বলেন, ‘আর ২০০১-২০০৬ শাসনামলে তিনি উচ্চশিক্ষার নজর দেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন করেন। ওই সময়টাতে ডুয়েট, চুয়েট, ‍রুয়েট, কুয়েট প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এক কথায় শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবদান অপরিসীম। খালেদা জিয়ার আরও যেসব চিন্তা-ভাবনা ছিল সেগুলো আগামীতে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের শিক্ষাখাত অনেকটা এগিয়ে যাবে।

এএএইচ/এমএএইচ/এএসএম