আন্তর্জাতিক

২০২৫ সালে এআই বিপ্লব: যেসব কাজে বদলে দিলো বিশ্ব

২০২৫ সালে প্রযুক্তির জয়যাত্রায় সবচেয়ে বড় নাম ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। বছরের শুরু থেকেই এআইয়ের বহুমুখী ব্যবহার নিত্যনতুন রেকর্ড গড়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা এবং স্থানীয় প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, এ বছর বেশ কয়েকটি খাতে এআইয়ের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। নিচে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

কর্মক্ষেত্রে এআই

২০২৫ সালে এআইয়ের সবচেয়ে বড় বিবর্তন ছিল ‘এআই এজেন্ট’। গত বছরের চ্যাটবটগুলো যেখানে শুধু প্রশ্নের উত্তর দিতো, এ বছরের এজেন্টগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ই-মেইল পাঠানো, মিটিং শিডিউল করা এবং জটিল প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের মতো কাজগুলো নিজে থেকেই সম্পন্ন করছে।

ম্যাকিনসে-এর সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের অন্তত একটি ব্যবসায়িক কাজে (যেমন: অ্যাডমিন বা আইটি) নিয়মিত এআই ব্যবহার করছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে (৫০০০+ কর্মী) এই হার অনেক বেশি, প্রায় ৭১ থেকে ৭৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়মিত প্রশাসনিক কাজে জেনারেটিভ এআই (যেমন কো-পাইলট) যুক্ত করেছে।

আরও পড়ুন>>এআই দিয়ে ‘আহত হাতের’ ছবি বানিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিলেন কর্মীরোবটের ‘গর্ভে’ মানবশিশু? চীনের গবেষণায় বিশ্বজুড়ে হইচইবিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কীভাবে সর্বাধুনিক এআই মডেলে ঝুঁকছে?২০২৬ সালেই এআই’র আসল প্রভাব দেখতে পাবে বিশ্ব

স্বাস্থ্যসেবায় এআই

২০২৫ চিকিৎসা খাতে এআইয়ের ব্যবহার এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। চীনে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া কঠিন ও ব্যয়বহুল। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশটিতে তরুণদের প্রায় অর্ধেকই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে এআই চ্যাটবটের শরণাপন্ন হয়েছে। তবে এর ঝুঁকিও আছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনপ্রিয় একটি এআই চিকিৎসা চ্যাটবট রোগীদের ভুল ও বিপজ্জনক পরামর্শ দিচ্ছে। তবু অনেক ব্যবহারকারীর কাছে এর মানবিক আচরণই বড় আকর্ষণ।

এআই ব্যবহৃত হচ্ছে প্রবীণদের যত্নেও। সিঙ্গাপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত প্রবীণদের সঙ্গে সপ্তাহে দুই দিন ব্যায়াম করায় ‘ডেক্সি’ নামে একটি মানবসদৃশ রোবট। দক্ষিণ কোরিয়ায় একাকী বসবাসকারী প্রবীণদের দেওয়া হচ্ছে এআই সঙ্গী রোবট, যাদের তারা নাতি-নাতনির মতো আদর করছেন।

স্বাস্থ্যকর্মীরাও এআই গ্রহণ করেছেন। ব্রাজিলের প্রত্যন্ত এক শহরে সরকারি ক্লিনিকের একমাত্র ফার্মাসিস্ট এআই সহায়তায় প্রেসক্রিপশন যাচাই করে বিপজ্জনক ভুল ধরতে পারছেন আগের তুলনায় চারগুণ বেশি দ্রুত।

সৃজনশীল কনটেন্ট ও মাল্টিমোডাল এআই

২০২৫ সালে কনটেন্ট তৈরির ধারণা পুরোপুরি বদলে গেছে। জেনারেটিভ এআই এখন শুধু টেক্সট বা ছবি নয়, উচ্চমানের ভিডিও এবং মিউজিক তৈরিতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছে।

ইন্দোনেশিয়ার চলচ্চিত্র ও অ্যানিমেশন শিল্পে দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে জেনারেটিভ এআই। চিত্রনাট্য লেখায় চ্যাটজিপিটি, ছবি তৈরিতে মিডজার্নি এবং ভিডিও সম্পাদনায় রানওয়ে ব্যবহার করছেন নির্মাতারা। এতে উৎপাদন খরচ কমছে এবং হলিউড মানের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন প্রযোজকরা।

সাইবার নিরাপত্তা ও জালিয়াতি রোধ

প্রযুক্তির অপব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি সুরক্ষায় এআইয়ের ব্যবহারও ছিল তুঙ্গে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন রিয়েল-টাইমে আর্থিক জালিয়াতি ধরতে এআই ব্যবহার করছে।

বিশ্বখ্যাত পেমেন্ট নেটওয়ার্ক মাস্টারকার্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের নতুন জেনারেটিভ এআই-ভিত্তিক প্রযুক্তি ‘ডিজিশন ইন্টেলিজেন্স প্রো’ রিয়েল-টাইমে লেনদেনের ধরন বিশ্লেষণ করে ‘ফলস পজিটিভ’ (অর্থাৎ বৈধ লেনদেনকে ভুলবশত জালিয়াতি মনে করা) প্রায় ৮৫ শতাংশ কমিয়ে এনেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর জালিয়াতি ধরার নির্ভুলতা অনেক বেড়ে গেছে।

ব্যক্তিগত সহকারী ও শিক্ষা খাতে বিপ্লব

শিক্ষার্থীদের জন্য এআই এখন ব্যক্তিগত শিক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। ২০২৫ সালে ‘অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং’ বা শিক্ষার্থীর মেধা অনুযায়ী পাঠ্যসূচি তৈরির কাজে এআই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তিগত স্মার্টফোনগুলোতে থাকা এআই অ্যাসিস্ট্যান্টগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষের মতো কথোপকথন চালাতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।

কেনিয়ায় শিক্ষক সংকট মোকাবিলায় অনেকেই এখন চ্যাটবটের সাহায্য নিচ্ছেন। নাইরোবির এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানান, ২০০ শিক্ষার্থীর জন্য পাঠ পরিকল্পনায় এআই তার বড় সহায়ক।

আইনি ব্যবস্থায় গতি

বিশ্বের সবচেয়ে মামলাবহুল দেশগুলোর একটি ব্রাজিল। সেখানে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা সাত কোটিরও বেশি। এই চাপ সামলাতে দেশটির বিচারব্যবস্থায় চালু রয়েছে ১৪০টির বেশি এআই প্রকল্প। এর সাহায্যে বিচারকরা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে পারছেন, অবশ্য একই সময় আইনজীবীরাও এআই ব্যবহার করে আরও বেশি মামলা করতে পারছেন। আগে যেখানে একটি আইনি নথি তৈরি করতে সময় লাগত ২০ মিনিট, এখন তা করা যাচ্ছে কয়েক সেকেন্ডে।

বহুমুখী কাজে এআই

ভাষাগত বৈষম্য কমাতে মঙ্গোলিয়ায় স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিনির্ভর এআই মডেল তৈরি করছে ‘এগুনে এআই’। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে স্থানীয় টেলিকম কোম্পানি, ব্যাংক ও সরকারি সংস্থাগুলো।

আফ্রিকার মালাউইয়ে কৃষকেরা দীর্ঘদিন মুখে-মুখে শেখার ওপর নির্ভর করলেও এখন নিজের ভাষায় এআই চ্যাটবট থেকে পাচ্ছেন তাৎক্ষণিক কৃষি পরামর্শ। এক কৃষক জানান, এআইয়ের পরামর্শ মেনে পোকামাকড়ের আক্রমণ পুরোপুরি দমন করতে পেরেছেন।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

তবে এই সফলতার পাশাপাশি ‘ডিপফেক’ ভিডিওর মাধ্যমে প্রতারণা এবং কর্মসংস্থানে এআইয়ের প্রভাব নিয়ে এ বছর বিশ্বজুড়ে ব্যাপক বিতর্ক চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ এআই ব্যবহারের কঠোর আইন বা ‘এআই অ্যাক্ট’ কার্যকর করেছে।

২০২৫ সালে এআই শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতার অংশ হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য, আইন, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে এআইয়ের এই বিস্তৃত ব্যবহার ইঙ্গিত দিচ্ছে—আগামী বছরগুলোতে মানবজীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব আরও গভীর হবে।

তথ্যসূত্র: রেস্ট অব ওয়ার্ল্ড, ম্যাকিনসে, ওপেনএআইকেএএ/