একুশে বইমেলা

মাদার অফ ডেমোক্রেসি: প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল

রবিউল ইসলাম

‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ বইটি কেবল একটি জীবনচরিত নয় বরং এটি সমকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বের এক প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইমরানুল হক চাকলাদার সম্পাদিত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বইটি বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই, অর্জন এবং তাঁর দর্শনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাঠকেরর সামনে তুলে ধরে।

বইটির নাম ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। খালেদা জিয়া বিশ্বের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি সমুজ্জ্বল নাম। তিনি জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। এ ছাড়া ২০২২ সালে কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বেগম খালেদা জিয়াকে এই উপাধিতে ভূষিত করে। লেখক অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া বইটির ভূমিকায় দেখিয়েছেন যে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বেগম জিয়ার ৯ বছরের আপসহীন সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দি থেকেও গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা তাঁকে প্রকৃত অর্থেই ‘গণতন্ত্রের মা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বইটির একটি বড় অংশজুড়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ: ‘১০ বছরের শাসনকাল: নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশু অধিকার’। এখানে খালেদা জিয়া শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে নারী শিক্ষার যে আমূল পরিবর্তন এনেছেন, তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা রয়েছে। যার মাঝে উল্লেখযোগ্য:শিক্ষা উপবৃত্তি: নারীদের দশম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালুর ফলে দেশে নারী শিক্ষার হার অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায়।সামাজিক অন্তর্ভুক্তি: বেগম খালেদা জিয়ার আমলেই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে নারীদের প্রথম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।সাফল্য: তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতা অর্জনে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্বে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

বইটিতে বিএনপির ‘ভিশন-২০৩০’-এর একটি বিস্তারিত রূপরেখা সংকলিত হয়েছে। এটি কেবল রাজনৈতিক ইশতেহার নয় বরং ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ২৫৬ পয়েন্টের একটি মহাপরিকল্পনা। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সুশাসন, ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান সংশোধন এবং তথাকথিত ‘ওয়ান ডে ডেমোক্রেসি’র পরিবর্তে সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির স্বপ্ন দেখানো হয়েছে।

বইটিতে বেগম জিয়ার ‘সৃজনশীল পররাষ্ট্রনীতি’ উঠে এসেছে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ও আব্দুল হাই শিকদার রচিত ‘খালেদা জিয়া—তৃতীয় বিশ্বের কণ্ঠস্বর’ বই থেকে সংকলন করার মধ্য দিয়ে।

আরও পড়ুনওঙ্কার: একটি দেশের জন্মকথা শেষের কবিতা: প্রেম ও বাস্তবতার অনন্ত সংলাপ 

শহীদ জিয়ার সার্ক গঠনের উদ্যোগকে তিনি কীভাবে আরও বেগবান করেছেন এবং চীন, জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ‘পূর্বমুখী নীতি’ গ্রহণ করেছেন, তা বইটিতে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘সেতুবন্ধ’ হিসেবে গড়ে তোলার তাঁর এই দর্শন আজ বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

বইটি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলা এবং ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর কারাবরণের যন্ত্রণাদায়ক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে। রুমিন ফারহানা, ড. মোর্শেদ হাসান খান এবং ড. জাহিদ দেওয়ান শামীমের মতো লেখকেরা দেখিয়েছেন কীভাবে বেগম জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার করা হয়েছে। কারাবরণের আগের দিন জাতির উদ্দেশে তাঁর দেওয়া সেই আবেগঘন ভাষণের প্রতিটি শব্দ বইটিতে সংরক্ষিত আছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন—‘আমি আপনাদের মাঝেই আছি... আপস করব না।’

সম্পাদনার মুন্সিয়ানা বইটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এতে যেমন বেগম খালেদা জিয়ার নিজের বক্তব্য ও প্রবন্ধ আছে; তেমনই ড. সুকোমল বড়ুয়া, অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম এবং অধ্যাপক তারিকুল ইসলামের মতো বিদগ্ধজনদের বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ বইটিকে গবেষণাধর্মী করে তুলেছে। বইটি বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের আদর্শ, সততা এবং দেশপ্রেমকে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছে।

‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ বইটি কেবল একটি রাজনৈতিক সংকলন নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের এক জীবন্ত ইতিহাস। এটি প্রমাণ করে যে, বেগম খালেদা জিয়া কেবল একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন বরং তিনি একটি আদর্শের নাম, যা শত প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি বুঝতে হলে এবং একজন নেত্রী কীভাবে জনগণের ভালোবাসায় ‘দেশনেত্রী’ থেকে ‘গণতন্ত্রের মা’ হয়ে ওঠেন; তা জানতে হলে বইটি পড়া প্রতিটি সচেতন নাগরিকের জন্য অপরিহার্য। এটি একটি ইতিহাসের আয়না, যেখানে দেখা যায় ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া একটি গণতান্ত্রিক দেশের করুণ ছবি এবং আশার এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন হলো একটি তরী, যা বারবার ঝড়ের মুখে পড়লেও তা অকুতোভয় ও আপসহীন মাঝির ন্যায় কখনোই দিক হারায়নি এবং জনগণের আস্থার বন্দরে নোঙর করে ছিলেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

এসইউ