ইয়িলদিরিম মারু
‘শূন্যের দরজা’ বইটি একটি চমৎকার ও গভীর দার্শনিক যাত্রা। যা হাসান ইথারের প্রথম বই হিসেবে পাঠকদের একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দেয়। বইটি শুধু একটি গল্প নয় বরং দর্শন, আধ্যাত্মিকতা এবং জীবনের গভীর অনুসন্ধানের একটি সৃজনশীল পথপ্রদর্শক। লেখক তার লেখার মাধ্যমে পাঠককে এমন একটি যাত্রায় নিয়ে যান; যেখানে তারা শূন্যতা, অস্তিত্ব, জীবন ও মৃত্যুর সঠিক অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারবেন। বইটির পেছনে যে জ্ঞান এবং তত্ত্ব কাজ করছে, তা পাঠকদের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। যা খুবই প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী।
বইটির মূল থিম অস্তিত্ব, শূন্যতা এবং জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক। হাসান ইথার দর্শনের মাধ্যমে পাঠককে সেইসব গভীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, যা সাধারণত আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কখনোই ঠিকভাবে ভাবি না। বইটির মাধ্যমে শূন্যতাকে জীবনের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের অস্তিত্বের সাথে অদৃশ্যভাবে সংযুক্ত।
যখন নাওফাল বিন আসাদ নামক প্রধান চরিত্র তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার জন্য একটি যাত্রা শুরু করেন, তখন তার এই অনুসন্ধান শুধু আধ্যাত্মিক নয় বরং একটি দর্শনীয় যাত্রাও। তিনি বুঝতে চান, জীবনের উদ্দেশ্য কী এবং কেন আমরা পৃথিবীতে আছি। আসাদ সাহেবের মধ্যে এমন একটি আধ্যাত্মিক বা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়, যা সমস্ত পাঠককে গভীর চিন্তা ও অনুসন্ধান করতে প্ররোচিত করবে।
উপন্যাসটি শুধু দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধান নয় বরং এটি জীবনের এক গভীর প্রশ্ন; যা পাঠককে চিন্তা করতে বাধ্য করে। লেখক এখানে জীবন এবং মৃত্যু, বাস্তবতা এবং অস্তিত্বের গভীরতা নিয়ে একেবারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন। লেখকের অফুরন্ত চিন্তা ও প্রশ্ন পাঠককে এক এক ধাপে নিজের অস্তিত্বের ব্যাপারে গভীরতর উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। বইয়ের কাহিনি সোজা এবং একরৈখিক হলেও এর মধ্যে রয়েছে চমৎকার দার্শনিক প্রশ্ন এবং জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত জটিলতা। লেখক চরিত্রগুলোর মধ্যে মননশীলতা এবং গভীরতা এমনভাবে একত্রিত করেছেন, যা পাঠকদের ভেতর একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা তৈরি করবে।
‘শূন্যের দরজা’ বইটির মধ্যে শূন্যতার ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেখক শূন্যতাকে শুধু একটি ভৌত বা গাণিতিক ধারণা হিসেবে নয় বরং এটি জীবন এবং অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এই শূন্যতার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই প্রশ্নগুলো; যা আমাদের অস্তিত্ব এবং পৃথিবীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। সাইফুল যখন আসাদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন, ‘শূন্য কীভাবে ক্ষুধার্ত হয়?’ এবং তার উত্তর আসে, ‘বিশ লক্ষ টাকা’। তখন শূন্যতার খোলামেলা ব্যাখ্যাটি সামনে আসে। এটি একটি উদাহরণ, যা পাঠককে জীবনের অভ্যন্তরীণ শূন্যতা এবং এর পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আরও পড়ুনপাপ ও পদ্মের পিঞ্জর: কৃষিজীবী জীবনের আখ্যান অনন্ত সংগ্রাম: ঘাত-প্রতিঘাতের জীবন
এ ছাড়া ‘সময়কে কীভাবে সময় দিতে হয়?’ এ প্রশ্নের মাধ্যমে সময়ের অসীমতা এবং পৃথিবীর সীমিততার মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ পায়। এটা পাঠকদের বুঝতে সাহায্য করে যে, আমাদের সময়ের মূল্য কীভাবে ধারণ করা উচিত এবং আমরা সময়কে কতটা উপভোগ করছি।
হাসান ইথারের ভাষা এবং লিখনশৈলী খুবই সুস্পষ্ট এবং জ্ঞানের গভীরতা তুলে ধরে। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দের মধ্যে এক অনন্য গভীরতা এবং ভাবনা রয়েছে; যা পাঠকদের গভীর চিন্তা করতে বাধ্য করে। লেখক তার চিন্তা-ভাবনাকে সহজভাবে প্রকাশ করলেও পাঠককে সে সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে প্ররোচিত করেন। তার উপস্থাপন শক্তিশালী এবং একেবারে সোজাসাপ্টা, যা যে কোনো পাঠককে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করবে।
বইটি এক ধরনের চিন্তা-ভাবনা এবং দর্শনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। হাসান ইথার পাঠকদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যান; যেখানে তারা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে শুরু করেন। এর মাধ্যমে লেখক পাঠকদের জীবনের উদ্দেশ্য এবং অস্তিত্বের গভীরতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বইটি একটি মানসিক যাত্রা, যেখানে মানুষ তার অন্তর্দৃষ্টি এবং দার্শনিক চিন্তা পুনরায় খুঁজে পায়।
পরিশেষে বলা যায়, ‘শূন্যের দরজা’ বইটি কারা পড়বেন এবং কেন? দার্শনিক ও গভীর চিন্তাশীল পাঠকরা–যারা অস্তিত্ব ও সময় নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানীরা–যারা জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজছেন। সাহিত্য ও চিন্তাশীল গল্পের পাঠকরা–যারা ভাবনাকে সমৃদ্ধ করতে চান। লেখক ও গবেষকরা–যারা শূন্যতা ও অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী। যারা ব্যক্তিগত সংকট বা অস্তিত্বের প্রশ্নে ভুগছেন–এই বই তাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে।
‘শূন্যের দরজা’ একটি অসাধারণ বই, যা জীবনের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার একটি প্রচেষ্টা। বইটির মাধ্যমে পাঠক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং আধ্যাত্মিক ধারণা গ্রহণ করবেন। যা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য এবং অস্তিত্বের গভীরতা সম্পর্কে নতুন চিন্তা আনবে। এটি শুধু দার্শনিকদের জন্য নয় বরং প্রতিটি মানুষের মানসিক জগতের উন্মোচন। হাসান ইথারের এই লেখার মাধ্যমে পাঠকেরা নিজেদের জীবন, পৃথিবী এবং অস্তিত্বের বিষয়ে আরও সচেতন এবং সমঝদার হয়ে উঠবেন।
এ ছাড়া জীবন-মৃত্যুর অন্তর্নিহিত রহস্য, বাস্তবতা এবং অবাস্তবের মাঝে রেখা তৈরি করার প্রতি বইটিতে বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। এখানে জীবনকে শুধু একমাত্র যাত্রা হিসেবে দেখানো হয়নি বরং এটি মুখ্য প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে মৃত্যু একটি দ্বার, যার মধ্য দিয়ে সবাই একদিন যেতে বাধ্য। এটি সত্যিকার অর্থে একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস।
বই: শূন্যের দরজালেখক: হাসান ইথারধরন: উপন্যাসপ্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশনমূল্য: ৩০০ টাকা।
এসইউ