একুশে বইমেলা

হাঙর নদী গ্রেনেড: মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান

মুহিবুল হাসান রাফি

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে তার বইসমূহে। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। যা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। সাহিত্যাঙ্গনে অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি দেয়।

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ পাশাপাশি তিনটি প্রতীকী শব্দ। আপাত অর্থে মিলহীন। কিন্তু ব্যাপ্তি অনেক গভীর ও প্রসারিত। যে হাঙর গোটা একটা জাতিসত্তাকে গিলে খায়, গিলে খেতে চায়। যে জাতির রয়েছে রক্ত দিয়ে লেখা একটা ইতিহাস, গভীর মর্মবেদনার একটা ভাষা। মাথার ওপর জনমদুখিনী মায়ের ছায়া আর স্নেহ-মমতামাখা প্রাণশক্তি। নারীর মতো নদী। নদীর মতো বহুমুখী শিল্প, সংস্কৃতি জারিত প্রবাহ। এই অনন্তকালের শান্ত নির্মল সুন্দর ধারাকে কেউ যদি ধ্বংস করতে চায়, ধ্বংসের নির্মম উল্লাসে মেতে ওঠে, তাদের প্রতিহত করতে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ—গ্রেনেড। এভাবে বর্ণের সঙ্গে বর্ণের, শব্দের সঙ্গে শব্দের অন্তর্নিহিত মেলবন্ধনে উঠে আসে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর সেলিনা হোসেন লিখেছিলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষক ছিলেন আবদুল হাফিজ। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রেসকোর্সে যাওয়ার সময় তিনি সেলিনা হোসেনের বাসায় উঠেছিলেন। এক মায়ের গল্প শুনিয়েছিলেন। যশোরের কালীগঞ্জের যে মা দুই মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রতিবন্ধী ছেলেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক হাফিজ এ ঘটনা নিয়ে লেখককে লিখতে বলেন। লেখক প্রথমে ভেবেছিলেন, ছোটগল্প লিখবেন। কিন্তু ঘটনার অনুরণন এত গভীর যে পরে লিখে ফেললেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার প্রথম উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’।

উপন্যাসটি পড়ে সত্যজিৎ রায় খুব প্রশংসা করেছিলেন। লেখককে চিঠি দিয়ে উপন্যাস অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রায়িত করে উঠতে পারেননি। পরে চাষী নজরুল ইসলাম যথাযথ নান্দনিক দর্শনে উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন। ১৯৯৭ সালে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।

উপন্যাসের প্রবহমানতার মতো পুরো কাহিনিকে খুব ধীর লয় ও মন্থরগতিতে রিলের মধ্যে গুটিয়ে আনতে পেরেছেন চাষী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যনির্ভর সুন্দর চলচ্চিত্র নির্মাণে সৃজনশীলতা ও দক্ষতায় তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

আরও পড়ুনপাপ ও পদ্মের পিঞ্জর: কৃষিজীবী জীবনের আখ্যান চরিত্রহীন: মানবমনের গভীর উপলব্ধি 

হলদিগাঁর এক দুরন্ত কিশোরী বুড়ি। কৈশোর থেকে সে চঞ্চলতায় উচ্ছল, কৌতূহলপ্রবণ, উৎসুক দৃষ্টি, নিবিড়ভাবে দেখা, চমৎকারভাবে মেশা, উচ্ছলতায় ভরপুর। কম বয়সেই বিয়ে হয় তার থেকে বয়সে অনেক বড় বিপত্নীক গফুরের সঙ্গে। গফুরের সংসারে তার আগের স্ত্রীর রেখে যাওয়া সলীম ও কলীম নামে দুটো ছেলে আছে। সংসারজীবন ভালোই লাগে বুড়ির। যদিও গফুর বুঝতে পারে না বুড়িকে। আগের বউ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কখন কী বলে, কী করে তা বোঝা তার পক্ষে কষ্টসাধ্য। সলীম-কলীম থাকলেও তার নিজের গর্ভের সন্তান চায়। অবশেষে ভূমিষ্ট হলো বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী রইস।

কিছুদিন পর গফুর মারা যায়। সলীমের বিয়ে হয় রামিজার সাথে। বুড়ির কোলজুড়ে আসে আরও একটি সন্তান। যুদ্ধের ঢেউ আসে হলদিগাঁয়ে। তছনছ হয়ে যায় বুড়ির সংসার। সলীম যায় যুদ্ধে। সলীমের ও মুক্তিবাহিনীর কোনো তথ্য না দেওয়ায় কলীমকে পাকিস্তানি আর্মি ও তার দোসররা বুড়ির চোখের সামনে নির্মমভাবে খুন করে। কিন্তু পলি ভরার আগে হলদিগাঁয়ের মাটিতে রচিত হলো মর্মান্তিক দৃশ্য। যে দৃশ্যের রচনাকার একজন মা। বুড়ি যার নাম। হাফেজ ও কাদের দুই মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে শত্রুপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে আশ্রয় নেয় বুড়ির ঘরে। পাকসেনারাও বাড়িতে আসে।

দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় একজন মা, মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে তার নিজের সন্তানকে তুলে দেয় পাকসেনাদের বন্দুকের নলের মুখে। সন্তানের নাম রইস। যার প্রতীতি এ রকম: ‘ওরা এখন হাজার হাজার কলীমের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছে। ওরা হলদীগাঁর স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে লড়ছে। ওরা আচমকা ফেটে যাওয়া শিমুলের উজ্জ্বল ধবধবে তুলো। বুড়ি এখন ইচ্ছে করলেই শুধু রইসের মা হতে পারে না। বুড়ি এখন শুধু রইসের একলার মা নয়।’ হাঙর নদী গ্রেনেড তখন মহাকাব্যের আখ্যান হয়ে ওঠে। বুড়ি হয়ে যায় ইতিহাস-কন্যা। আর হলদিগাঁ, বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসের কাহিনির বুননে এই যে গ্রামীণ জীবনযাপন, গরু দিয়ে ধান মাড়াই, হেঁটে হেঁটে পা দিয়ে নেড়েচেড়ে রোদে কচি ধান শুকানো, ওলানে মুখ রেখে বাছুরের দুগ্ধপান, হাঁস-মুরগি পালন, ডিম তুলে আনা, চাষি গফুরের লাঙল কাঁধে মাঠ থেকে ফেরা, গাছ কাটা গাছির মতো শরীরে জড়ানো দড়ি, মাটির উনুনে কাঠ-খড় জ্বালিয়ে রান্না, ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল গুঁড়া করা, সরল বিশ্বাসী গ্রামের মানুষের বৃক্ষকে সাক্ষী করে মানত, মাজারে ধুলায় গড়াগড়ি খাওয়া, গ্রাম্য বালকের পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান, কুটুমপাখির ডাক—অপরূপ এসব দৃশ্যই তো চোখে বারবার ভাসে, মনে গেঁথে যায়।

বুড়ির মতো মায়েরা তবু একদিন আকাশটাকে মুক্ত করার, দেশটাকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে পেটের নাড়িছেঁড়া ধন ছেলে রইসকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছে। চোখের সামনে গুলি খেয়ে মরতে দেখেছে। প্রতিবন্ধী রইস চরিত্রে বিজয় চৌধুরীর অভিনয় কখনো ভোলা যাবে না। বুড়ি আসলে বাংলার হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার মা। বুড়ির মতো মায়েদের ত্যাগের বিনিময়ে রক্তের নদী পেরিয়ে আজকের স্বাধীনতা। আজকের বাংলা ভাষার দেশ, বাংলাদেশ।

সেলিনা হোসেন এমন একটি বাস্তব উপন্যাস লিখতে পেরেছিলেন এবং চাষী নজরুল ইসলাম চলচ্চিত্রায়িত করতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো আজও তাই আমাদের চোখের সামনে ভাসে। আমাদের শোকে সন্তপ্ত করে।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ।

এসইউ