আজ ২৯তম রমজান। আজ চাঁদ দেখা গেলে আগামীকাল আমরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করবো, ইনশাআল্লাহ।
অনেকেই হয়তো মাহে রমজানের এই শেষ সময়ে ইবাদতের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আধ্যাত্মিক খাদ্য গ্রহণের পরিবর্তে বাহ্যিক খাদ্যের দিকেই যেন আমাদের আগ্রহ বেশি।
মাহে রমজানের একেবারেই আমরা শেষ প্রান্তে রয়েছি। এই শেষ মুহূর্তে আমাদেরকে অনেক বেশি দোয়ায় রত থেকে অতিবাহিত করতে হবে। কেননা তিনিই ভালো জানেন কার দোয়া কখন গ্রহণ করে নেন।
যে ব্যক্তি প্রকৃত প্রেরণা নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে আল্লাহতায়ালা তাকে কখনও ব্যর্থ হতে দেন না। যেভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। কিন্তু যারা আমার ইবাদত সম্বন্ধে অহংকার করে, তারা নিশ্চয় লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ (সুরা মোমেন, আয়াত: ৬০)।
আবার তিনি বলছেন ‘অথবা কে উদ্বিগ্নচিত্ত ব্যক্তির দোয়া শুনেন যখন সে তার নিকট দোয়া করে এবং তার কষ্ট দুর করে দেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করে দেন? আল্লাহর সাথে কি অন্য কোন উপাস্য আছে? তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ কর’ (সুরা নামল, আয়াত: ৬২)।
আল্লাহতায়ালা তার বান্দার দোয়া গ্রহণ করার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করেন, কখন তার বান্দা তাকে ডাকবে আর তিনি তা গ্রহণ করবেন এবং তার দু:খ কষ্ট দুর করবেন। তিনি সবার খুবই নিকটে রয়েছেন, যেভাবে কোরআনে আরো উল্লেখ রয়েছে ‘আর যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তখন বল, আমি নিকটে আছি। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার উত্তর দেই যখন সে আমার নিকট প্রর্থনা করে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সারা দেয় এবং আমার ওপর ঈমান আনে যাতে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬)।
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, তিনি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকেন। আমারা যদি প্রকৃতভাবে তাকে ডাকি তাহলে অবশ্যই তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দিবেন।
পবিত্র এ মাস মুমিনের পরিবারের জন্য বসন্তের মাস। এ মাসে প্রতিটি মুমিন হৃদয় যেমন লাভ করে আল্লাহপাকের জান্নাতের প্রশান্তি তেমনি তাদের পুরো পরিবারও হয়ে ওঠে শান্তিময়। আমরা যদি আমাদের পরিবারগুলোকে শান্তিময় করতে চাই তাহলে পবিত্র এ রমজানের নেক আমলগুলো বছর জুড়ে অব্যাহত রাখতে হবে। রমজানের দিনগুলোতে যেভাবে পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে ইবাদত-বন্দেগি করেছি ঠিক একইভাবে রমজানের পরেও তা অব্যাহত রাখতে হবে।
পরিবারের প্রধান হিসেবে আমাদেরকে সন্তানদের প্রতি রমজানে যেভাবে দৃষ্টি দিয়েছিলাম রমজানের পরেও বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। রমজান শেষে শুধু নিজে নেক আমল করতে থাকবো আর পরিবারের অন্যরা যা ইচ্ছে তা করবে এটা যেন কোনভাবেই হতে না দেই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন থেকে বাঁচাও’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬)।
তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সে যেন কেবল নিজেই মুত্তাকি না হয় বরং সে নিজে এবং পরিবারের সকলকে পুণ্যবান-মুত্তাকি করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
সব ধরণের পাপ ও খারাপ থেকে বাঁচাবার জন্য তাদেরকে সঠিকভাবে শিক্ষা দেয়। আমরা যদি সন্তানদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষায় লালিত-পালিত করি তাহলে পরিবার, সমাজ, জাতি, দেশ সর্বত্রেই শান্তি বিরাজ করবে এটা নিশ্চিত।
সন্তানদের যদি আমরা উত্তম শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলি তাহলে এদেশে থাকবে না কোন সন্ত্রাসী, থাকবে না কোন চোর-ডাকাত, হতে পারে না কোন মারা-মারি আর কাটা-কাটি।
এমন সংবাদ আমাদেরকে কখনই শুনতে হবে না যে নেশাখোর সন্তানকে পিতা হত্যা করে বলছেন ‘আজকে আমি শান্তি পাচ্ছি’। সন্তানের জন্য সেই পিতাকে কতটা কষ্ট সহ্য করলে এমন মন্তব্য করতে পারে। একটু ভেবে দেখেছেন কি? তাই সন্তানকে উত্তম আদর্শ দিয়ে গড়ে তুলার বিকল্প নেই।
আমাদের সন্তানরা যদি ভালো মানুষ হয় তাহলে এক কথায় বলা যায় সকল প্রকার অরাজকতা থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের প্রতি দৃষ্টি না দেই তাহলে খোদাতায়ালার কাছে আমরা অবশ্যই এর জন্য জিজ্ঞাসিত হব।
পরিবারের কর্তা হিসেবে সন্তানদের প্রতি আমার যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তা আমাকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। পরিবারের সদস্যদেরকে শুধু ইবাতদের কথাই বলবো না বরং তাদের প্রয়োজনের দিকেও আমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
হাদিসে এসেছে হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তুমি একটি দিনার আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছ, একটি দিনার ক্রীতদাস মুক্তিতে ব্যয় করেছ, একটি দিনার মিসকিনকে দান করেছ এবং একটি দিনার পরিবারের লোকদের জন্য ব্যয় করেছ। এ খরচ করা দিনারগুলোর মধ্যে নিজ পরিবারের লোকদের জন্য খরচ করা দিনারের মূল্য-প্রতিদান লাভের দিক থেকে সর্বোত্তম।’ (মুসলিম)
সাধ্য অনুযায়ী পরিবারের সদস্যদের জন্য খরচ করা এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় তাদের গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব।
আমরা আশা করি রমজান মাসে নিজেদের নেক আমলের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের মাঝেও কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। কেননা রমজান মাস হচ্ছে প্রশিক্ষণের মাস। এ মাসে সন্তানরা যে ভালো প্রশিক্ষণ লাভ করেছে তা যেন তারা ভুলে না যায় সে বিষয়ে প্রত্যেক পিতামাতাকে দৃষ্টি দিতে হবে।
প্রত্যেকটি পরিবারে কেবল তখনই প্রশান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হতে পারে যখন পরিবারের সদস্যরা আল্লাহর দেয়া দায়িত্বানুভূতি সম্পর্কে সজাগ থাকবে। পরিবারের প্রত্যেকে প্রত্যেকের দায়িত্ব যখন পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করবে তখন সেই পরিবার হবে একটি আদর্শ পরিবার।
এতে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে থাকবে সুসম্পর্ক, সন্তানরা তাদের বাবা-মায়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করবে আর আত্মীয়-স্বজনরা যখন যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা পাবে তখনই আল্লাহর রহমত, বরকত ও অনুগ্রহ সেই পরিবারে বর্ষিত হতে থাকবে।
আমরা যদি আল্লাহপাকের আদেশ নিষেধ পরিপূর্ণভাবে প্রথমে নিজেরা পালন করে জীবন অতিবাহিত করি এবং সন্তানদেরকে নসিহত করি তাহলে দেখবেন তাদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে আর আমাদের ঘরগুলো হবে শান্তিময়।
তাই আসুন, রমজানের শেষ সময়টুকু নিজ, পরিবার এবং বিশ্ববাসীর জন্য অনেক বেশি দোয়া করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের রোজাগুলো গ্রহণ করে নিন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।masumon83@yahoo.com
এইচআর/জেআইএম