আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যুগেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু। সিলেটে গত তিন বছরে দুই হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু মাতৃগর্ভেই হয়েছে। সামাজিক কুসংস্কার, অপুষ্টি, অসচেতনতাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণে মায়ের গর্ভেই মারা যাচ্ছে অসংখ্য শিশু। এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।
‘আমাদের এলাকায় একজন নারী গর্ভবতী এই খবরটা পরিবার-প্রতিবেশী ছাড়া অন্য কেউ জানা মানেই পাপ। সেখানে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া মানে মহাপাপ। প্রতিটি পরিবারই এরকম রক্ষণশীল।’ কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের ফারুক মিয়া।
স্ত্রী নাজমা বেগমের গর্ভকালীন চিকিৎসার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘স্ত্রীকে গর্ভকালীন সময়ে কীভাবে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাব, আর কীভাবে পরিবারের সবাইকে বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পরে আমরা অত্যন্ত কৌশলে আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে লুকিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতাম। কখনো কখনো উপজেলা শহরে কেনাকাটা করার কথা বলেও চিকিৎসকের কাছে গিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রীর কিছু সমস্যা ছিল। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া না গেলে প্রথম বাচ্চাটা হয়ত আলোর মুখ দেখতো না।’
মাতৃগর্ভে শিশুমৃত্যুর জন্য চিকিৎসাগত ও স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা প্রধান কারণ হলেও সমাজে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কুসংস্কারের কারণে পরিবারের চাপে অনেক গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কুসংস্কারের কারণে ও পারিবারিক চাপে জিম্মি হয়ে পড়েন স্বামীরা।
এতে করে গর্ভবতীদের আধুনিক চিকিৎসা প্রদানের পরিবর্তে ওঝা-ফকিরের ঝাড়ফুঁক ও ভেষজ ওষুধের প্রতি আগ্রহ থাকে। এসব ভ্রান্ত বিশ্বাস ও সামাজিক চাপে অনেক সময় মাতৃগর্ভে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। তাছাড়াও দাই বা অপটু ধাত্রী দ্বারা প্রসব করানোর কারণে জন্মের পরও অনেক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
আরও পড়ুন- বাড়ছে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু, যা বলছেন চিকিৎসকরা মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু, নেপথ্যে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অসচেতনতাস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গর্ভ ধারণের পুরো সময়ে একজন মাকে অন্তত চারবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার অনেক নারী প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে একবার চিকিৎসকের কাছে আসেন। এসময় জটিল কোনো সমস্যা থাকলেও চিকিৎসকের কিছু করার থাকে না।
এ অবস্থায় মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ নিশ্চিতের প্রতি জোর দিচ্ছেন চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকার গ্রাম পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়ন কমিউনিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গর্ভকালীন সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কিন্তু সামাজিক কুসংস্কারের কারণে প্রত্যন্ত এলাকার একজন স্বাস্থ্যকর্মীর কাছেও গর্ভকালীন বিষয় জানাতে চান না অনেক নারী। এসব কারণে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলার একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্য সহকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কিছু মানুষ মনে করেন গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের কাছে যাওয়া অশুভ লক্ষণ। এসব কুসংস্কারের কারণে তারা প্রসবকালীন জটিলতা বা গর্ভকালীন সমস্যা নিয়েও বাড়িতে বসে থাকেন। যা শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি বলেন, ‘গর্ভকালীন সময়ে অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের কাছে এমনও রোগী আসেন, যাদের প্রসবের তারিখ খুব সন্নিকটে থাকে। তখন কোনো জটিল সমস্যা থাকলেও সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। এটাও শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ।’
‘গর্ভকালীন সময়ে অনেক পরিবারের শাশুড়িরা গর্ভবতী নারীদের ‘অমঙ্গলের’ কারণে চিকিৎসকের কাছে যেতে নিষেধ করেন।’
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির যুগেও সমাজে কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গর্ভকালীন সময়ে অনেক পরিবারের শাশুড়িরা গর্ভবতী নারীদের ‘অমঙ্গলের’ কারণে চিকিৎসকের কাছে যেতে নিষেধ করেন। পরিবারের চাপে অনেক স্বামীও জিম্মি হয়ে পড়েন। যার কারণে নারীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার স্বাস্থ্য পরিদর্শক করুনা কান্ত দেব জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখনও সমাজে অনেক কুসংস্কার রয়েছে। কুসংস্কারের কারণে গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয় না। আর যারা একবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আসেন তারা অনেক কিছু লুকিয়ে রাখেন। অনেক সমস্যা স্বাস্থ্যকর্মীদের জানানও না। হাসপাতালে বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্য রেফার্ড করে দেওয়া হবে, এই ভয়ে অনেক গর্ভবতী মা স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই আসেন না।’
তিনি বলেন, ‘পারিবারিক ও সামাজিক অনেক কুসংস্কার ছাড়াও নারীদের পুষ্টিগত সমস্যা ও অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণের কারণে গর্ভে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সিলেট অঞ্চলে এই সমস্যাটা অনেক বেশি। আমরা চেষ্টা করছি এটা রোধ করার জন্য। এজন্য মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর প্রতিটি কেস আমরা যত্ন সহকারে নোট করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করি। যাতে অন্য গর্ভবতীদের মধ্যে এ ধরনের লক্ষণ থাকলে তারা সচেতন থাকতে পারেন।’
গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক রাশিদা আখতার বলেন, ‘গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপ করা খুবই প্রয়োজন। বিদেশে একজন মাকে গর্ভকালীন সময়ে অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে। আমাদের দেশে গর্ভাবস্থায় অনেকে ডাক্তারের কাছে যায় না। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে একবার চিকিৎসকের কাছে যান। তখন কোনো সমস্য থাকলে সেটার কোনো সমাধান করা সম্ভব হয় না।’
শহরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে না পারলেও অন্তত প্রত্যন্ত এলাকায় সরকারের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক রাশিদা আখতার বলেন, ‘প্রত্যন্ত এলাকার মায়েদের গর্ভাবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে না পারলেও গ্রামীণ পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে গিয়েও নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে। সেখানে গেলেও তারা অনেক বিষয় বুঝবে। বেশি জটিল মনে হলে তারাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেবে।’
তিনি বলেন, ‘গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই প্রয়োজন। অনেকে এটা বুঝেই না। মনে করে বাচ্চা ভালো আছে। পরে বাচ্চা মারা গেলে ডাক্তারের কাছে আসে।’
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী বলেন, ‘মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু রোধে অনেক সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। আমাদের মায়েরা স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়া নির্দেশিকা মানতে রাজি না। এজন্য প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা আমরা গুরুত্ব দিয়ে সংগ্রহ করে রাখি।’
কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সিলেট নগরীর ২৪টি স্কুল-মাদরাসায় কৈশোরকালীন পুষ্টি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। ইউনিসেফের সহযোগিতায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচির আওতায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির কিশোরীদের প্রতি সপ্তাহে দুইটি করে আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খাওয়ানো হচ্ছে। এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি টিম প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে তদারকি করছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, একজন মা গর্ভাবস্থায় ১০০টি আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট সেবন করলে গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গের হাত থেকে রক্ষায় ৯০ শতাংশ কাজ করবে। দাম কম হলেও এটা খুবই কার্যকরী একটি ট্যাবলেট। কৈশোরকালীন পুষ্টি নিশ্চিত করতে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৪টি স্কুল-মাদরাসায় এই কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এটি সব সময় অব্যাহত থাকবে।
এফএ/এএসএম