সিলেট

বাড়ছে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু, যা বলছেন চিকিৎসকরা

আহমেদ জামিল
আহমেদ জামিল আহমেদ জামিল , জেলা প্রতিনিধি সিলেট
প্রকাশিত: ১২:৫৩ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যুগেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু। সিলেটে গত তিন বছরে দুই হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু মাতৃগর্ভেই হয়েছে। সামাজিক কুসংস্কার, অপুষ্টি, অসচেতনতাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণে মায়ের গর্ভেই মারা যাচ্ছে অসংখ্য শিশু। এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

বিয়ের প্রথম বছরেই গর্ভধারণ করেন ২০ বছর বয়সী ফাহমিদা জান্নাত। গর্ভধারণের ২৫ সপ্তাহ থেকে আগত সন্তানের নিয়মিত নড়াচড়া টের পেতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগত সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। প্রসবের দিনক্ষণ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল।

কিন্তু ব্যথা না ওঠায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অপেক্ষা করতে থাকেন। হঠাৎ গর্ভে সন্তানের নড়াচড়া না পেয়ে দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে নেওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গর্ভেই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান চিকিৎসক। এরপর চিকিৎসকদের দীর্ঘ ২০ ঘণ্টার চেষ্টায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি।

অনেকটা একই আলামত ছিল বেসরকারি চাকরিজীবী খালেদ আহমদের স্ত্রীর। গর্ভে সন্তানের নড়াচড়া কম পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ফাহমিদার মতো খালেদের স্ত্রী রাফসানাও শুনলেন একই দুঃসংবাদ। এই দম্পতির প্রথম সন্তান ছিল এটি। অসহনীয় ব্যথা-কষ্টে তাকেও মৃত সন্তান প্রসব করতে হয়েছে।

ফাহমিদা ও রাফসানা ছাড়াও প্রতি বছর এ রকম অসংখ্য মায়ের গর্ভে তার আগত সন্তানের মৃত্যু হচ্ছে। গর্ভধারণের ২৫-২৬ সপ্তাহ পর থেকে প্রসবের আগ মুহূর্ত পর্যন্তও এরকম ঘটনা ঘটছে। দীর্ঘদিন গর্ভে ধারণ করার পর মৃত সন্তান জন্ম দিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন মায়েরা। কেবল তাই নয়, মৃত সন্তান প্রসবের কারণে অসহায় মায়েদের পড়তে হচ্ছে পারিবারিক-সামাজিক বিড়ম্বনায়।

সিলেটে প্রতি বছর বাড়ছে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর এই হার। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, সিলেটে গত তিন বছরে দুই হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু মাতৃগর্ভেই হয়েছে। এরমধ্যে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সিলেটে মাতৃগর্ভে ৭৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর আগের বছর ২০২৩ সালে ৭৪০ জন ও ২০২২ সালে ৫৭০ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে মাতৃগর্ভে মারা যাওয়া ৫৭০ শিশুর মধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৬৪ জন ও বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে ২০৬ জন।

২০২৩ সালে মারা যাওয়া ৭৪০ জন শিশুর মধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৮৩ জন, খাদিমপাড়া হাসপাতালে ৭ জন ও বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে ১৫০ জন।

তাছাড়া ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সিলেটে মাতৃগর্ভে ৭৩২ শিশুর মৃত্যুর হিসাব পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৮৩ জন, খাদিমপাড়া হাসপাতালে ১৫ জন ও বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও ১৫০ জন। এর বাইরে সিলেটের বেসরকারি হাসপাতালেও মাতৃগর্ভে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এসব শিশুর মৃত্যুর কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। হাসপাতাল ছাড়াও বাসা-বাড়িতে অনেক মৃত শিশুর জন্ম হচ্ছে। সেগুলোর তথ্যও যোগ হচ্ছে না সরকারের খাতায়।

চিকিৎসকরা বলছেন, মাতৃগর্ভে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ এখনও অজানা। মৃত শিশুর রিপোর্ট তৈরি বা অনুসন্ধান করলেও মৃত্যুর সঠিক কারণ পাওয়া যায় না। আর যেসব কারণ শনাক্ত করা যায় তার বেশিরভাগ অংশই মায়ের সমস্যাজনিত। মায়েদের সমস্যার মধ্যে অসচেতনতা-অপুষ্টি ও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ। এর বাইরে রয়েছে অজ্ঞতা-অশিক্ষা ও কুসংস্কার।

এ অবস্থায় মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতনতার পাশাপাশি ‘প্রি-কনসেপশন’ ও ‘ডিউরিং প্রেগনেন্সি’ এই দুই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলছেন চিকিৎসকরা।

সিলেটের গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক রাশিদা আখতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাতৃগর্ভে মারা যাওয়া শিশুদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশেরই কোনো কারণ শনাক্ত করা যায় না। মৃত শিশুর জন্মের পর রিপোর্ট তৈরি করলে বা ইনভেস্টিগেশন করলে কোনো কারণ পাওয়া যায় না। তবে মায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে অনেকগুলো কারণ পাওয়া যায়।’

তিনি বলেন, ‘মায়ের সমস্যা, শিশুর সমস্যা ও গর্ভফুলের সমস্যার কারণে গর্ভে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। তাছাড়াও কিছু পারিপার্শ্বিক কারণ থাকে। গর্ভে শিশুর মৃত্যুর জন্য মায়ের যে কারণগুলো পাওয়া যায় তারমধ্যে অন্যতম হলো- মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গর্ভে ইনফেকশন, অতিরিক্ত জ্বর এবং রক্ত-প্রস্রাবের ইনফেকশন।’

তাছাড়া ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা, অনিয়মিত ওষুধ সেবন, ভুল ওষুধ সেবন ও ‘আরলি প্রেগন্যান্সি’ এসবের কারণেও গর্ভে সন্তানা মারা যেতে পারে বলে জানান অধ্যাপক রাশিদা।

ডা. রাশিদা আখতার আরও বলেন, ‘অনেক সময় মাল্টিপল প্রেগন্যান্সির কারণেও বাচ্চার বিকলাঙ্গতা দেখা দেয়। তাছাড়াও স্বামী-স্ত্রীর ব্লাড গ্রুপের কারণেও গর্ভে শিশু মারা যায়। যেমন বাবার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ ও মায়ের পজিটিভ। এসব কারণেও অনেক সময় গর্ভে সন্তান মারা যেতে পারে।’

অধ্যাপক রাশিদা বলেন, ‘অনেক সময় শিশুর বিকলাঙ্গতা, গর্ভে ইনফেকশন, পেটে শিশুর অবস্থান, অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়ার কারণে মায়ের গর্ভেই শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকে। অনেক সময় নাড়ি বাচ্চার গলায় পেঁচিয়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যু হয়। আবার জেনেটিক কিছু কারণেও মাতৃগর্ভে শিশুর মৃত্যু হয়।’

ডা. রাশিদা জাগো নিউজকে বলেন, যখন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে তখন আমরা মায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকি। পরবর্তীতে যাতে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে না হয়, সেজন্য মাকে কিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়। তবে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে ‘প্রি-কনসেপশন’ ও ‘ডিউরিং প্রেগন্যান্সি’ এই দুই বিষয়কে গুরুত্ব দিতে বলেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। মাতৃগর্ভে শিশুর নড়াচড়া না পেয়ে হাসপাতালে অসংখ্য রোগী আসেন। আমাদের চিকিৎসকরা মাতৃগর্ভে বাচ্চাকে স্বাভাবিক করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু তারপরও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। প্রতি মাসেই মাতৃগর্ভে অনেক শিশু মারা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সময় গর্ভের সন্তান মৃত অবস্থায় নিয়ে হাসপাতালে আসেন। এরকম কিছু ঘটলে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করিয়ে থাকি। গর্ভে সন্তান মারা গেলে আমাদের হাসপাতালে সিজার করা হয় না। যদি পরিস্থিতি খুবই জটিল হয় সেটা ভিন্ন কথা।’

এফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।