সিলেট

মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু, নেপথ্যে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অসচেতনতা

আহমেদ জামিল
আহমেদ জামিল আহমেদ জামিল , জেলা প্রতিনিধি সিলেট
প্রকাশিত: ১১:৫৮ এএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যুগেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু। সিলেটে গত তিন বছরে দুই হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু মাতৃগর্ভেই হয়েছে। সামাজিক কুসংস্কার, অপুষ্টি, অসচেতনতাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণে মায়ের গর্ভেই মারা যাচ্ছে অসংখ্য শিশু। এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

সিলেটে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার অনুযায়ী সবার ওপরে রয়েছে বিয়ানীবাজার উপজেলা। আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কানাইঘাট উপজেলা। এছাড়াও অন্যান্য উপজেলা হাসপাতালেও প্রতিমাসে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। হাসপাতাল ছাড়াও বাসা-বাড়িতেও এমন ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও কুসংস্কারের কারণে কানাইঘাট উপজেলায় মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার পরও বিয়ানীবাজার উপজেলায় আশঙ্কাজনক হারে শিশু মৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সিলেটের ১১ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে মাতৃগর্ভে ৪৯০টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিয়ানীবাজার উপজেলায়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কানাইঘাট উপজেলা ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৮৬ জন, কানাইঘাট উপজেলায় ৫৩ জন, জৈন্তাপুর উপজেলায় ২৭ জন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ১৬ শিশুর মাতৃগর্ভে মৃত্যু হয়েছে।

২০২৩ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৩৭ জন, কানাইঘাট উপজেলায় ২৩ জন, জৈন্তাপুর উপজেলায় ১৬ জন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ২১ জন; এছাড়া ২০২৪ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলায় ২৭ জন, কানাইঘাট উপজেলায় ৩১ জন, জৈন্তাপুর উপজেলায় ১০ জন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ২৫ জন শিশুর মাতৃগর্ভে মৃত্যু হয়েছে।

তাছাড়াও অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর ঘটনাও কোনো বছরে বাদ যাচ্ছে না। এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও বাসা-বাড়িতে গর্ভে সন্তানের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এসব মৃত্যুর তথ্য সরকারের হিসাবের বাইরে রয়েছে।

সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে মাতৃগর্ভে মারা যাওয়া ৫৭০ শিশুর মধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৬৪ জন ও বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে ২০৬ জন।

২০২৩ সালে মারা যাওয়া ৭৪০ জন শিশুর মধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৮৩ জন, খাদিমপাড়া হাসপাতালে ৭ জন ও বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে ১৫০ জন।

তাছাড়া ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সিলেটে মাতৃগর্ভে ৭৩২ শিশুর মৃত্যুর হিসাব পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৮৩ জন, খাদিমপাড়া হাসপাতালে ১৫ জন ও বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও ১৫০ জন শিশু মায়ের গর্ভেই মারা গেছে।

কুসংস্কার-অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থায় কানাইঘাটে বাড়ছে মৃত্যু

সিলেট জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্গম ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় পিছিয়ে কানাইঘাট উপজেলা। মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হারেও এগিয়ে এই উপজেলা।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও কুসংস্কারের কারণে প্রতিবছরই এই উপজেলায় মাতৃগর্ভে অসংখ্য শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। বিশেষ করে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে হাসপাতালমুখী হতে রাজি হন না রোগীরা। শুধু তাই নয়, ভাঙাচোরা সড়কে অনেক সময় রাস্তার মধ্যেও সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটছে। ভয়ে অনেকে হাসপাতালে না গিয়ে চিকিৎসক বাড়িতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।

কানাইঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ইরফানুল হক বলেন, মাতৃগর্ভে মৃত্যুর অনেকগুলো কেস স্টাডি করে দেখা গেছে, তাদের বাড়ি দুর্গম এলাকায়। দূরত্ব বেশি থাকায় প্রসব ব্যথা ওঠার পরপরই হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসে না। তারা বাড়িতে অদক্ষ দাই দিয়ে অনেক চেষ্টা করে। যখন ব্যর্থ হয়ে যায় তখন হাসপাতালে নিয়ে আসে। অনেক বেশি দেরি করার কারণে শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকে।

তিনি বলেন, অনেক দাই আছেন রোগীদের ভুল বুঝিয়ে থাকেন। যার কারণে হাসপাতালে না এনে বাড়িতেই চেষ্টা করে। এতে দাইদের আর্থিক বিষয়টি জড়িত। তারাই রোগীদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।

মায়েদের অসচেতনতার কথা উল্লেখ করে ডা. ইরফান বলেন, আমি এমনও অনেক রোগী দেখেছি, যারা ৭-৮টি বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন, কিন্তু একদিনও একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি। শেষ বয়সে যখন আবার বাচ্চা নিতে যান তখন আমাদের কাছে আসেন। আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার কথা বললে তারা বলে টাকা নেই। এতে অনেক ঝুঁকি বেড়ে যায়।

মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতন করার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে মায়েদের জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক সেমিনার আয়োজন করে থাকি। প্রতিদিন একজন মা এলেও ক্লিনিকে তাকে স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়া হয়। তবে গর্ভবতী নারীরা এসব নির্দেশিকা খুব একটা মানেন না। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বিয়ানীবাজারে এত মৃত্যু কেন

গত তিন বছরে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় ১৫০ জন শিশুর মাতৃগর্ভে মৃত্যু হয়েছে। এর বাইরে বাসা-বাড়িতেও অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজতর হওয়া সত্ত্বেও বিয়ানীবাজারে এতো মৃত্যুর কারণ জানা নেই কারো।

সংশ্লিষ্টরা মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুললে চিকিৎসকরা বলেন, অন্যান্য উপজেলার মতো বিয়ানীবাজারেও মৃত্যু কমছে। কিন্তু মায়ের অসচেতনতা-পুষ্টিহীনতা ও চিকিৎসক সংকটের কারণে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবুল মনসুর আমজাদ জাগো নিউজকে বলেন, মায়েদের পুষ্টিহীনতা ও অসচেতনতার কারণে অনেক সময় গর্ভে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এসব শিশু মৃত্যু রোধে গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করা হয়। কিন্তু মায়েদের মধ্যে সচেতনতা তুলনামূলকভাবে বাড়ানো যাচ্ছে না। এখনও অনেক কুসংস্কার সমাজে রয়েছে। যেসব কারণে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু হচ্ছে।

তিনি বলেন, শুধু মায়েদের অসচেতনতা বা পুষ্টিহীনতা নয়, চিকিৎসকের অভাবেও অনেক মৃত্যু ঘটছে। আমরা চেষ্টা করছি জনবলের সংকট কমাতে। কিন্তু পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় মাঠ পর্যায়ে অনেকে সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। এর বাইরে অজানা কারণে অন্তত ২০-৩০ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।

সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে আমাদের জনবল কম রয়েছে। আমরা জনবল সংকট নিরসনে কাজ করছি। যেসব হাসপাতালে চিকিৎসকদের পদ খালি রয়েছে, সেগুলো পূরণ করার জন্য প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।