দেশজুড়ে

নাফ নদীতে এক বছরে তিন জেলে নিহত, নিখোঁজ ১০

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে যান বাংলাদেশিরা। সেখানে গিয়ে নিখোঁজ হন অনেকে। কারো কারো ৫-৬ মাস ধরে কোনো খোঁজ নেই। এরমধ্যে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে তিন জেলে নিহত হয়েছেন বলে দাবি পরিবারের। আর এখনো নিখোঁজ ১০ জন। তারা আদৌও জীবিত নাকি মৃত পরিবার কিছুই জানে না।

নিহত তিনজন হলেন- টেকনাফের হোয়াইক্যং ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোলাপাড়া কালো মিয়ার ছেলে বশির আহমেদ, একই ওয়ার্ডের সৈয়দ বলির ছেলে মো. ইলিয়াস হোসেন, এবং উখিয়ার পালংখালি মৃত মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে ছৈয়দুল বশর।

নিখোঁজ ১০ জন হলেন- টেকনাফের হোয়াইক্যং ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে ছৈয়দ হোসেন, আবুল হাসমের ছেলে মো. রফিক, মৃত আবুল হাসিমের ছেলে মোস্তফা, নবী হোসেনের ছেলে আব্দু শুক্কুর।

আর হোয়াইক্যং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের লম্বা ঘোনার মৃত ওসামংয়ের চাকমার ছেলে চইলামং চাকমা ও মৃত মং তাইং চিং চাকমার ছেলে কেমং তুই চাকমা।

এছাড়া আরও নিখোঁজ হলেন- উখিয়ার পালংখালী আনজুমানপাড়া এলাকার জিয়াবুলের ছেলে সাইফুল ইসলাম, নুর মোহাম্মদের ছেলে লুৎফর রহমান, মনজুর আলমের ছেলে মো. ইউসুফ ও আব্দুল্লাহর ছেলে ইউসুফ জালাল।

স্থানীয়রা জানান, মিয়ানমারের রাখাইন দখল নিতে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ায় দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে আরাকান আর্মি ঘুমধুম, উখিয়া ও টেকনাফের ওপারের রাখাইন সীমান্তের অধিকাংশ চৌকি ও ক্যাম্প দখল করে।

এরমধ্যে এপারের জেলেরা জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদীতে মাছ ধরতে যান। সেই সঙ্গে চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজনও কাঁকড়া ধরার জন্য যান। প্রায় সময় আরাকান আর্মির হাতে বাংলাদেশি জেলেরা আটক হলেও পরে ছাড়া পেয়ে যেতেন।

কিন্তু গত এক বছরে বিভিন্ন সময় নাফ নদীতে গিয়ে নিখোঁজ হন ১৩ জন। এরমধ্যে তিনজন নিহত হন। তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানায় পরিবার।

এদের মধ্যে পালংখালির বাসিন্দা ছৈয়দুল বশরের গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া গেলেও বাকি হোয়াইক্যং ২ নম্বর ওয়ার্ডের বশির আহমেদ ও মো. ইলিয়াসের মরদেহ পরিবার পাইনি। অপরদিকে দীর্ঘ ৭-৮ মাস পার হয়ে গেলোও এখনো ১০ জনের কোনো হদিস নেই।

ভিকটিম চইলামং চাকমার মা চুচিং চা চাকমা বলেন, আমার ছেলে চাইলামং চাকমা ও কেমং তুই চাকমাসহ গত ১০ মাস আগে নাফ নদীতে কাঁকড়া ধরতে যান। তখন আরাকান আর্মির সদস্যরা তাদের ধরে নিয়ে যায়। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির করেও ফেরত দেয়নি। এখন তারা বেঁচে আছে কি না মরে গেছে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

নিহত মো. ইলিয়াস হোসেনের বড় ভাই মো. সামসু আলম বলেন, সাত মাস আগে আমার ছোট ভাই মো. ইলিয়াস নাফ নদীতে নৌকা নিয়ে রাতে মাছ ধরতে গেলে আরাকান আর্মির সদস্যরা তাকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। পরে স্থানীয় জেলেরা ইলিয়াসকে উদ্ধারের চেষ্টা করেও তার মরদেহ এপারে আনতে পারেনি। এখন তার স্ত্রী-সন্তানরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

পালংখালির আনজুমান পাড়ার নিহত ছৈয়দুল বশরের মা নয়না খাতুন কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার সন্তান পরিবারের একমাত্র সম্বল ছিল। তাকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে পড়েছি। নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে আরাকান আর্মি পাঁচ মাস আগে তাকেসহ মোট ৫ জনকে নিয়ে যায়। এর দুদিন পরে ছৈয়দুল বশরের গুলিবিদ্ধ মরদেহ পালংখালি সীমান্তের নাফ নদীতে পাওয়া যায়।

নিখোঁজ সাইফুল ইসলামের মা লায়লা বেগম বলেন, সাইফুলসহ পাঁচ জেলে আনজুমানপাড়া সীমান্তের নাফ নদীতে ৫ মাস আগে মাছ ধরতে যায়। এসময় সন্ধ্যার দিকে আরাকান আর্মির সদস্যরা আমার ছেলেসহ ওই পাঁচজনকে আটক করে। আটকের দুদিন পর ছৈয়দুল বশরের গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া গেলেও, আমার ছেলে সাইফুলসহ বাকি তিনজন লুৎফর রহমান, মো. ইউসুফ ও ইউসুফ জালালকে তারা ফেরত দেয়নি।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, জীবিকার তাগিদে জেলেরা নাফ নদীতে মাছ ধরতে গেলেও আরাকান আর্মির ভয়ে আতঙ্কে থাকেন। নদী যেহেতু বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মধ্যে পড়েছে, সেক্ষেত্রে রাতের আধারে অনেক সময় জেলেরা মিয়ানমারের জলসীমায় চলে যান। তখন আরাকান আর্মির সদস্যরা তাদের ধরে নিয়ে যায়।

পালংখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে আরাকান আর্মির হাতে আটক ৯ নম্বর ওয়ার্ড আনজুমানপাড়ার পাঁচ জেলের মধ্যে ছৈয়দুল বশর নামে এক জেলের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তবে বাকি আর চার জেলে এখনো নিখোঁজ। পাঁচ মাস পার হয়ে গেলো তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহেসান উদ্দিন বলেন, আরাকান আর্মির হাতে যেসব জেলে আটক হয়েছিলেন তারা ফেরত এসেছেন। তবে এখনো যে ৯ জেলে নিখোঁজ বা তিনজন আরাকান আর্মির হাতে নিহত হয়েছেন তার সুনিশ্চিত কোনো তথ্য জানা নেই। বিষয়টি বিজিবিকে জানানো হবে।

উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, পালংখালি আনজুমানপাড়ার যে চার জেলে নাফ নদী থেকে নিখোঁজ হয়েছেন, এ বিষয়ে ভিকটিমদের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানায়নি। তবুও খবর নেবো।

এ বিষয়ে উখিয়া ব্যাটালিয়নের (৬৪ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. জসিম উদ্দিন বলেন, নিখোঁজ বা নিহত জেলেদের বিষয়ে জানা নেই। তবে জেলেরা চুরি করে নাফ নদীর মিয়ানমার সীমান্তে চলে যান। তাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা চলবে।

জাহাঙ্গীর আলম/জেডএইচ/জিকেএস