জাতীয়

চব্বিশের নেতারা প্রত্যাশার জায়গাটি নষ্ট করে অপকর্মে জড়িয়েছেন

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সারাদেশে শিক্ষার্থী ও জনতার পাশাপাশি সম্মুখ সারিতে ছিল দেশের শিক্ষক সমাজের একাংশ। এই তালিকায় যেসব শিক্ষকের নাম অগ্রগণ্য তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার।

আন্দোলনের সময় ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউট্যাব) কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। সাদা দল সমর্থিত এ শিক্ষক আন্দোলনকালীন অভিজ্ঞতা ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক হাসান আলী।

জাগো নিউজ: আপনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কীভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন? সে সময়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

ড. কালাম সরকার: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা দলের ব্যানারে মিছিল-মিটিং করেছি, বিবৃতি দিয়েছি, ইউট্যাবের ব্যানারে মিছিল করেছি। বিএনপির কর্মসূচিতে আমরা পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে অংশ নিয়েছি। যখন যেভাবে ডাক এসেছে আমি সরাসরি প্রত্যেকটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা বিভিন্ন ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে গেছি।

যখনই ছাত্র-জনতা দলমত নির্বিশেষে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একাকার হয়ে গেছে তখনই সফলতাটা এসেছে। এর ক্রেডিট অবশ্যই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের, কিন্তু এককভাবে তারা সেটার দাবিদার নয়

আমরাই সাদা দলের ব্যানারে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রদের ৯ দফার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি। সেই সময় আমাদের অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমরা দেখেছি, আন্দোলন একেক সময় একেক দিকে বাঁক নিয়েছে। আমি যেহেতু ক্যাম্পাসে থাকি, আমার বাসা ফুলার রোডেই, দেখতাম বিভিন্ন মিছিল আসতো, শেষের কয়েকদিন আমরা আর দেখিনি কাদের মিছিল, কারা করছে। শিক্ষকদের মিছিল নাকি ছাত্রদের মিছিল সেসব না দেখেই মিছিলে অংশ নিয়েছি। তখন প্রায় প্রতিদিনই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতো, সেদিকেও খেয়াল করতাম না।

জাগো নিউজ: আপনার মতে, ওই অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি কী ছিল? শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের এত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কেন হয়েছিল বলে মনে করেন?

ড. কালাম সরকার: মূলত গত ১৭ বছরে ফ্যাসিবাদের জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা এতই ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, যার কারণে এদেশের শিক্ষক, ছাত্র-জনতা সবার আসলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। আর কোনো উপায় ছিল না। এরকম নয় যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন শুরু হয়েছে তখনই আমরা সম্পৃক্ত হয়েছি। আমরা ফ্যাসিবাদের শুরু থেকেই দীর্ঘ সময় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। যখনই কোনো জুলুম হয়েছে, এর প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী দল কোনো কর্মসূচি দিয়েছে, আমরাও সেটির সঙ্গে আন্দোলন করেছি। এসব নিয়ে আমরা বিভিন্ন সেমিনার করেছি, বিবৃতি দিয়েছি, বিভিন্ন কর্মসূচি করেছি।

আরও পড়ুন ৫ আগস্টের পর ভেঙেছে স্বপ্ন, পদত্যাগ করলেন ছাত্রদল নেতা আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে সরে দাঁড়ালেন ফেনীর বৈষম্যবিরোধীর সমন্বয়ক জুলাইয়ের প্রথম প্রহরে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন যশোরের বৈছাআ আহ্বায়ক

আমি মনে করি, তাদের যে আওয়ামীকরণ, সবকিছুতে বাড়াবাড়ি এবং জুলুম-অত্যাচারের কারণেই এদেশের ছাত্র-জনতা, সাধারণ মানুষ সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে ছিল। বিএনপি অন্য বিরোধীদলগুলো নিয়ে সংগ্রাম করছিল, কিন্তু এটাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে পারছিল না, সফলতা আসছিল না। যখনই ছাত্র-জনতা দলমত নির্বিশেষে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একাকার হয়ে গেছে তখনই সফলতাটা এসেছে। এর ক্রেডিট অবশ্যই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের, কিন্তু এককভাবে তারা সেটার দাবিদার নয়।

আমি কীভাবে বাইরে থাকবো? তারচেয়ে যদি গ্রেফতার হই বা গুম হই, সেটা আমার সন্তানদের সামনে থেকেই হই। ভবিষ্যতে যেন আমার সন্তানরা তাদের বাবার সাহসিকতা নিয়ে গর্ব করতে পারে। এজন্য শত ভয় থাকা সত্ত্বেও আমি কখনো বাসা থেকে অন্যত্র থাকিনি

জাগো নিউজ: আন্দোলন চলাকালীন কোনো হুমকি বা ভয়ভীতির শিকার হয়েছিলেন?

ড. কালাম সরকার: ভয়ভীতি তো অবশ্যই ছিল। কারণ অতীতের ইতিহাস বলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বরাবরই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তো। আমরা কোথায় যাই, কী করি এসবের সিসিটিভি ফুটেজ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেওয়া হতো, যাতে আমাদের নজরদারিতে রাখা যায়। তবুও আমরা কর্মসূচিতে যেতাম।

আমাদের ওপর থেকে বলা হয়েছিল, আমরা যাতে বাসায় না থাকি। আমাদের অনেক শিক্ষকই থাকতেন না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার বাসায় ছোট ছোট বাচ্চাগুলো অনিরাপদ রেখে আমি কীভাবে বাইরে থাকবো? তারচেয়ে যদি গ্রেফতার হই বা গুম হই, সেটা আমার সন্তানদের সামনে থেকেই হই। ভবিষ্যতে যেন আমার সন্তানরা তাদের বাবার সাহসিকতা নিয়ে গর্ব করতে পারে। এজন্য শত ভয় থাকা সত্ত্বেও আমি কখনো বাসা থেকে অন্যত্র থাকিনি।

জাগো নিউজ: আপনি সে সময় সাদা দল এবং ইউট্যাবের দায়িত্বে ছিলেন। সংগঠন দুটি কীভাবে আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে?

ড. কালাম সরকার: আমরা সব সময় চেয়েছি যে কোনোভাবে আন্দোলন সফল করতে। যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সংগঠনের ব্যানারে গিয়েছি, আবার যেখানে ব্যানার দরকার নেই সেখানে ব্যানার ছাড়াই গিয়েছি। আমার মনে আছে, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের একটা কর্মসূচি ছিল। তারা নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকের ব্যানারে সেটি করেছিল। আমরা সেখানেও গিয়েছিলাম। সেখানে সর্বোচ্চ ১২-১৩ জন শিক্ষক ছিলেন, আমাদের সাদা দলেরই শিক্ষক ছিলেন পঞ্চাশের বেশি। তারা আমাদের সেখানে কথা বলতেও দেয়নি, তবুও আমরা তাদের ব্যানারেই ছিলাম। কারণ আমরা চেয়েছি যেভাবেই হোক, আন্দোলনটা সফল হোক।

একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে কাপড়-চোপড়, ব্যাগ, লাঠিসোঁটা পড়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। এটা দেখে আমার অবস্থা যে কী হয়েছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না

আরও পড়ুন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন উমামা ফাতেমা এনসিপির কর্মিসভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাকে হাতুড়িপেটা ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি/ফেনীতে সমন্বয়ক ও চাকরি প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা

সেখান থেকে আমরা শাহবাগ থানায় গিয়ে ছাত্রদের ছাড়িয়ে এনেছি। সাদা দলের এত বড় অংশগ্রহণ ছিল বলেই সেটি সম্ভব হয়েছিল। আমরা সাদা দলই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদত্যাগ ও স্বৈরাচারের পতন চেয়েছি। ৫ আগস্ট আমরাই সারাদেশে প্রথম ইউট্যাবের ব্যানারে কারফিউ ভঙ্গ করেছি।

জাগো নিউজ: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এমন কোনো ঘটনা কী আছে যেটি আপনার এখনো মনে পড়ে?

ড. কালাম সরকার: ১৫ জুলাই যখন আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয় তখন আমি বিভাগের একটা কর্মসূচির কারণে টিএসসির পরিচালকের কক্ষে ছিলাম। আমি যখন সেখান থেকে বের হলাম, তখন দেখলাম ছাত্রলীগের ছেলেরা লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র এমনকি কয়েকজন হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা সেখানে উল্লাস করছিল। আমি তখনো জানতাম না বাইরে কী হয়েছে। আমি সেখান থেকে আমার বাসার দিকে গেলাম। তখন দেখলাম, চতুর্দিকে জুতা পড়ে আছে। একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে কাপড়-চোপড়, ব্যাগ, লাঠিসোঁটা পড়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। এটা দেখে যে আমার অবস্থা কী হয়েছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

আমরা এখানে ভাষা আন্দোলন, ৬৯, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী আন্দোলন দেখেছি। সে সময় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা কিন্তু পরবর্তীসময়ে ভোগ করার চিন্তায় ছিলেন না। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলনের নেতারা ভোগ করছেন

এরপর আমি জেনেছি যে এখানে ছাত্রলীগ তাদের তাণ্ডব চালিয়েছিল। উত্তর ফুলার রোডে বাসা হওয়ায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করি। আমি প্রতিদিন সকালে যখন ক্লাস নিতে এই পাশে হেঁটে আসি, তখন জায়গাটা নীরব থাকে যেমনটি ছিল, সেদিনের ঘটনার পরের সময়টা। চারদিকে জুতা, লাঠিসোঁটা, রক্তের দাগ—সেই দৃশ্য প্রতিটা দিনই ওই পাশে আসার সময় আমাকে ব্যথিত করে। আমি প্রতিটি সকালেই সেই বীভৎস দৃশ্যের কথা মনে করে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেদিন সরকারপন্থি কিছু শিক্ষক, সহকারী প্রক্টররা কিন্তু ভিসির বাসায়ই ছিলেন, তবুও তারা এগিয়ে আসেননি।

জাগো নিউজ: অভ্যুত্থান শিক্ষাক্ষেত্রে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো পরিবর্তন এনেছে কি? শিক্ষক হিসেবে আপনি কী মনে করেন?

ড. কালাম সরকার: অবশ্যই একটা পরিবর্তন এসেছে। গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারা যেগুলো ছিল, সেগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। গণরুমের কথাই যদি ধরি, সেটি এখন নেই। ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছিল যে সেটি মাপার কোনো যন্ত্র ছিল না। একজন দারোয়ান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ বডি পর্যন্ত ফ্যাসিস্টের সমর্থক হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষকদের বিবেক-বিবেচনাও লোপ পেয়েছিল। যেখানে দলীয় বিবেচনার বাইরে কিছু চিন্তা করা হতো না, সেখানে এই অল্পদিনে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা এসেই কারিকুলাম পরিবর্তনসহ নানান উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা আশা করি এ পরিবর্তনগুলো আরও বাস্তবায়ন হবে।

জাগো নিউজ: এক বছর আগে ফিরে তাকালে আপনার কি মনে হয় জুলাইয়ের যে দাবি বা আকাঙ্ক্ষা সেটি পূরণ হয়েছে? না হলে কী কারণ দেখেন?

ড. কালাম সরকার: আমরা যতটুকু আশা নিয়ে এ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, ততটুকু পরিবর্তন হয়নি। আর এটা একদিনে সম্ভব নয়। ১৭ বছরে যে বঞ্চনা, জুলুম, নির্যাতনের ভিত্তি তৈরি হয়েছে সেটি থেকে উত্তরণ এত দ্রুত সহজ নয়। এর অন্যতম কারণ আমাদের মানসিকতা। ১৭ বছরের যে রাজনৈতিক কালচার সেটি আমাদের মনে অকপটে গেঁথে আছে। এ জায়গা থেকে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।

যারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে তারাও যে এখন সেই জায়গায় শতভাগ রয়েছে তাও কিন্তু নয়। আমরা এখানে ভাষা আন্দোলন, ৬৯, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী আন্দোলন দেখেছি। সে সময় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা কিন্তু পরবর্তীসময়ে ভোগ করার চিন্তায় ছিলেন না। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলনের নেতারা ভোগ করছেন। তারা কয়েকজন মন্ত্রিত্ব নিয়েছেন, আবার তাদের সংগঠনের লেয়ার ধরে দ্বিতীয় সারি, তৃতীয় সারি—এভাবে করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে লোকজনকে বসিয়েছেন। যারা বসেছেন তারাও কিন্তু আমাদের প্রত্যাশার জায়গাটি নষ্ট করে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়েছেন। এসব কিছু আমাদের অনেক পীড়া দেয়। এ ব্যর্থতা আমাদের সবার। তারা যদি এ ব্যর্থতার পরিচয় না দিতেন, তাহলে মনে হয় আমাদের এ অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ভালো লাগতো।

এমএইচএ/এএসএ/এমএফএ/এএসএম