রাজনৈতিক অঙ্গনেও সক্রিয় সংগীতশিল্পী মনির খান। গত বছরের জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন তিনি। গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে দেশ, নির্বাচন, রাজনীতি ও সংগীত ক্যারিয়ার নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বললেন এই শিল্পী।
জাগো নিউজ: জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি হলো। এ আন্দোলন চলাকালে আপনিও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন। প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে? মনির খান: ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া অনেক পরের কথা। দেশের মানুষ ও দেশটাকে ভালো রাখার প্রত্যাশাই সবার আগে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দেশের জন্য বিশাল একটি অর্জন। ছাত্রদের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষ মিলে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে। এ অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলো, কিন্তু যে আশা নিয়ে, যে উদ্দীপনা নিয়ে স্বৈরশাসককে বিদায় করলাম, এতদিনেও সে আশা পূরণ হয়নি, একটা নির্বাচন হওয়া খুব জরুরি ছিল।
জাগো নিউজ: নির্বাচন কেন জরুরি বলছেন? নির্বাচনের আগে পরিবেশ তৈরির কাজ করা কি জরুরি নয়?মনির খান: কোনো রাজনৈতিক দলের হাতে দেশটা নেই বিধায় দেশের ভেতরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। টেলিভিশন, সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায় মানুষ হত্যা, ছিনতাই, ধর্ষণ, মারামারির খবর। এগুলো দেখে আমাদের সাধারণ মানুষের মনের ভেতর প্রতিদিনই রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বিকেববান মানুষ এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারছেন না। আমরা যারা সুস্থ চিন্তার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে চাই, বিবেক বিবর্জিত কিছু কর্মকাণ্ড দেখে তাদের অন্তরে ভীষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমরা এটা আশা করিনি। আমরা চাই অচিরেই একটা নির্বাচনের মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করা হোক। সাধারণ জনগণ যাকে চায়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটা সরকার রাজতৈকিভাবে গঠিত হোক। দেশের আইন শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। মোট কথা, আমরা শান্তি চাই।
জাগো নিউজ: শিল্পী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার পরামর্শ কী?মনির খান: তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনটা দিয়ে জনগণের প্রতিনিধির হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে দিলে সবকিছু জবাবদিহিতার মধ্যে আসতো। এখন কোনো কিছুর জন্য কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই বলে মনে হচ্ছে। আমার কথা হলো, এখন একটাই পথ, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে সঠিকভাবে দেশ পরিচালনার একটা নীতিমালা তৈরি করা। এ ছাড়া এই অরাজকতা বন্ধ করা খুব মুশকিল।
জাগো নিউজ: বর্তমান সরকার জানাচ্ছে তারা অনেক কাজ করছে। সেগুলোর ইতিবাচক কী কী আপনার চোখে পড়েছে?মনির খান: শুরুতেই ছাত্রদের ধন্যবাদ জানাই। তারা এগিয়ে না এলে বিগত সরকারের পতন এত দ্রুত হতো না। স্বৈরাচার সরকারকে আমরা সরাতে পারতাম না। ছাত্রদের সঙ্গে সারা দেশের মানুষ যখন এক হলো, তখন পরিবর্তনের আবহাওয়া তৈরি হলো। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠিত অভ্যুত্থানের পর তৎকালীন সরকারের বিদায়ে মানুষের মাঝে নতুন স্বপ্ন তৈরি হলো। এরপর প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো। এটিই একটি বড় ইতিবাচক দিক। সেই সময়ে যদি ইউনূস সাহেবের মতো একজন ব্যক্তির হাতে দেশটা না থাকতো, তাহলে বড় একটা বিপর্যয় হতে পারতো। তিনি বিশ্বের কাছে একজন গ্রহণযোগ্য মানুষ। তিনি বাংলাদেশের অহংকার। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সম্মান অর্জন করেছেন, নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ নন, অর্থনীতিবিদ। এ কারণে তিনি বিভিন্নভাবে মিসগাইডেড হয়েছেন হয়তো। তারপরও তাকে স্যালুট জানাই। তার মতো মানুষ দেশের হাল ধরেছেন বলেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকে আছে। তিনি সরকার পরিচলানার দায়িত্ব পেয়েই যদি দ্রুত একটি নির্বাচন দিয়ে দিতেন, তাহলে সবচেয়ে ভালো হতো। তাহলে তিনি দেশটাকে একটা ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারতেন। যদি সত্যিকারার্থে আগামী ডিসেম্বর বা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনটা হয়, তাহলে দেশে যে অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা চলছে, তা থেকে আমরা দ্রুত মুক্তি পাব।
জাগো নিউজ: আপনি একসময় রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাজনীতিতে নাকি শেষ কথা বলে কিছু নেই। আপনি কি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন?মনির খান: আমি পদ-পদবী থেকে দূরে ছিলাম, দল থেকে নয়। অনেকেই জানতে চান আমি নির্বাচনে অংশ নেব কি না। এটা আমার দলের সিদ্ধান্ত। সন্তানের সঙ্গে বাবার অভিমান থাকতে পারে। স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর অভিমান হয়। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর অভিমান হয়। যেখানে আন্তরিকতা গভীর থাকে, সেখানে অভিমানের ব্যাপার থাকে। আমি দলের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কথা বলিনি। দলের প্রতি অভিমান তৈরি হয়েছিল বলে, কিছুদিন দূরে ছিলাম। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। আমি কখনো কোথাও নিজের লাভের জন্য, নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যাইনি। কারণ আমি একটা দলের নীতি নিয়ে চলি, একটা দলের আদর্শে বিশ্বাস করি। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে, তার নীতির ওপর আস্থা রেখে আমি তার দলে যুক্ত হয়েছিলাম। যেখানে বিশ্বাস, যেখানে আস্থা ও ভালোবাসা রয়েছে, সেখানে অন্য কোনো চিন্তা করার প্রশ্নই আসে না। এখন দল সিদ্ধান্ত নেবে যে, আমাকে কোনো কাজে লাগালে আমি দলের উপকারে আসবো কি না। বিগত সরকারের আমলে আমার নামে দশটা মামলা হয়েছে। তখন আমি জাসাসের সাধারণ সম্পাদক, সেই ২০০৮ সাল থেকে। আমার জার্নিটাও দীর্ঘ।
জাগো নিউজ: আপনি কি নিজের নির্বাচনী এলাকায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা প্রচার-প্রচারণা করছেন?মনির খান: আমি দীর্ঘ এগারো বছরেরও বেশি সময় ধরে আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। আমার নির্বাচনী এলাকা মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলা নিয়ে। এ জেলায় মোট চারটা আসন। আমার আসন ঝিনাইদহ-৩। মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর এলাকা নিয়ে সেই আসন। আমি একজন শিল্পী হিসেবে বা একজন সমাজসেবক হিসেবে তাদের কাছে বেশ পরিচিত। আমি তাদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কাজ করেছি। সেখানে আমি আরও কাজ করতে চাই। এখনো সেখানকার মানুষের চাহিদা হচ্ছে, দীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসনে নিষ্পেষিত জীবন থেকে উদ্ধারের জন্য তাদের একজন ভালো মানুষ। যে মানুষকে দিয়ে হয়রানি বা শোষণমূলক কাজ হবে না। অত্যাচারিত জীবন যেন কাটাতে না হয়, এজন্য ভালো মানুষ তারা বেছে নিতে চায়। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। জনগণ বেছে নেবে তাদের যাকে দরকার, এবং আমার দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও আমার নেতা জনাব তারেক রহমান, নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নেবেন যে, কাকে বেছে নিলে ভালো হবে।
জাগো নিউজ: একই এলাকার একাধিক প্রার্থী দেখা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে কী হবে? আপনি তো শিল্পী। এই পরিস্থিতি কীভাবে সমাধা করবেন? মনির খান: দল যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্ত মেনে আমরা কাজ করি। তবু সব জায়গায় আমরা দেখি যে, দলের মধ্যে গ্রুপিং আছে। দলের মধ্যে দুইটা-তিনটা গ্রুপ থাকে। যেমন একটা গ্রুপ একজনের পিছু ছুটছে। আরেকটা গ্রুপ আরেকজনের পিছু ছুটছে। আমি সবাইকে একটা আহ্বান জানাবো যে, অনেক কঠিন অবস্থার মধ্যদিয়ে দেশটা আরেকবার স্বাধীন হলো। এই স্বাধীনতার যে স্বাদ, সেটা নিজেদের ভুলের কারণে যেন কোনোভাবেই লুণ্ঠিত না হয়। কোনোভাবেই যেন আমরা সেটা নষ্ট না করি। এই নতুন অর্জনের ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, সচেতন থাকতে হবে। দল আমার-আপনার সবার। এই দলের মধ্যে আমার অবস্থান পোক্ত হোক বা আমার স্বার্থ উদ্ধার হোক – এ চিন্তা না করে দেশ ও দলের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় আমরা সবাই একত্রিত হয়ে কাজ করবো। এটাই আমার বার্তা। মহেশপুর-কোটচাঁদপুরে আমার যেন এক হয়ে কাজ করতে পারি, এক ছাতার নিচে কাজ করতে পারি, সেই চিন্তা করতে হবে। আমার যেন নিজেদের মধ্যে মারামারি-হানাহানি-কোন্দল সৃষ্টি না করে, একত্রে কাজ করতে পারি, দলকে শক্তিশালী করতে পারি, এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। আমরা সবাই একযোগে কাজ করবো, একযোগে কাজ করলেই আমাদের জয় নিশ্চিত এবং সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
জাগো নিউজ: সংগীত নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?মনির খান: আমার তো জন্মই হয়েছে সংগীতের জন্য, আমি এই কথাটা বিশ্বাস করি। মানুষ আমাকে গ্রহণ করেছে। সংগীতের জগতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। প্রায় ৩০ বছরের ক্যারিয়ার আমার। সংগীতই আমার সাধনা, সংগীতই আমার জীবন। সংগীত আমার পেশা, সংগীতই আমার ভবিষ্যৎ বলে আমি মনে করি। সংগীতের মধ্যেই আমার বেঁচে থাকা। সংগীতের বাইরে আমার কখনো অন্য কোনো পেশা ছিল না, এখনো নেই। এর বাইরে অন্য কিছু করার চিন্তাও আপতত নেই। এটাও ঠিক যে, সংগীত ও রাজনীতি দুটোই জনগণের জন্য। মানুষের জন্য কিছু করার ক্ষেত্রে রাজনীতি অনেক বড় প্ল্যাটফর্ম। যদি সুযোগ পাই, এই জায়গা থেকে এলাকার মানুষের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য বাকি জীবনটা উৎসর্গ করতে চাই। তবে সৃষ্টিকর্তা জানেন কোথায় কখন কী হবে। সংগীত যেহেতু আমাকে অনেক ভালো রেখেছে, অনেক শান্তিতে রেখেছে, তাই সংগীতের মধ্যেই আছি এবং সংগীত নিয়ে সারাজীবন থাকতে চাই। আমি সবার কাছে দোয়া চাই, আমি যেন সুস্থ সংগীতচর্চার মাধ্যমে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সবার সঙ্গে থাকতে পারি, সবার ভালোবাসায় থাকতে পারি।
জাগো নিউজ: কেউ কেউ বলেন, আগে আপনার গানগুলো অনেক সাড়া ফেলতো। এখনকারগুলো আগের মতো সাড়া ফেলছে না। আপনার কী মনে হয়? কেনো এমনটা হচ্ছে? সংগীত ভুবনটা কি তাহলে বদলে গেছে?মনির খান: আমার সংগীতজীবন বদলে যায়নি। সাফল্য এক জিনিস এবং মানুষের ভালোলাগা আরেক জিনিস। আমি ‘ভাইরাল’ শব্দের সঙ্গে কখনই একমত নই। আমরা সবাই এখন ‘ভাইরাল’ শব্দটির সঙ্গে আপোষ করে ফেলেছি। ভাইরাল না হলে যেন বেঁচে থাকা অর্থহীন। এই ভাইরাল জিনিসটা আমি অপছন্দ করি। সুস্থ সংগীত কখনো মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে না। আমি সব সময় সুস্থ সংগীতের পক্ষে। আমি যদি আজ কুরুচিপূর্ণ কথা বা সময়ের দাবি মেটানোর জন্য যা-তা কথা দিয়ে গান গাইতাম, তাহলে ভাইরাল হতাম। আমি তো সেই জিনিসটা করতে পারবো না। আমি অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছিলাম, জীবনে একটাও অশ্লীল কথার গান গাইবো না। অশ্লীল কথার গান গাইলে আমি ভাইরাল হবো, দেখা যাবে যে গান হিট হয়েছে। আর গানের হিট হওয়া মানেই তো লাখ লাখ ভিউ হলো, সেটা কিন্তু আদতে হিট গান নয়। আমাকে দেখতে হবে যে, গানটি বছরের পর বছর বেঁচে আছে কি না। মানুষ সবসময় শুনবে কি না। যে গান দশ দিনের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেল, সেটি কিন্তু হিট গান নয়। বেঁচে থাকার গান কোনটা সেটা আমাকে দেখতে হবে। আমি তো বেঁচে থাকার গান করি। আমি গানের মধ্যদিয়ে মানুষের জীবনের কথা বলি। প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলি। এজন্য বলবো, ভাইরাল এক জিনিস, ভালো গান আরেক জিনিস। আমি ভালো গানের পক্ষে।
জাগো নিউজ: এখন কী করছেন? নতুন গান করছেন কি?মনির খান: গান চলছে। আমার দুটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। নিয়মিত সেখানে নতুন নতুন গান প্রকাশ করছি। স্টেজ শো এখন একটু কম। বর্ষার সময় এখন স্টেজ তেমন একটা নেই। কিছুদিন পরই আবার স্টেজ শো বাড়বে। সেইসঙ্গে দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও বাড়বে। এখন দেশের সব সেক্টরেই অস্থির পরিস্থিতি। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর থেকে কনসার্ট করে ফিরলাম।
আরও পড়ুন:সাংস্কৃতিক পরিবেশকে সুস্থ ধারায় ফেরাতে সংস্কৃতিকর্মীর দায় রয়েছেউপস্থিত নাহিদ, বৈষম্যবিরোধী গান গাইলেন মনির খানএমএমএফ/এমআই/আরএমডি/জেআইএম