খেলাধুলা

‘পাঁচ তারকা হোটেলে যখন থাকি বাবা-মাকেই বেশি মনে পড়ে’

উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁয়ের রাণীশংকৈলে চায়ের দোকান চালানো লিটন ও আনজু আরা বেগম দম্পতির মুখে এখন তৃপ্তি আর গর্বের হাসির শেষ নেই। অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে সংসার চালানো এই দম্পতির কন্যা মোসাম্মাৎ সাগরিকা এখন কেবল তাদের কাছেই গর্বের নয়, পুরো দেশের মানুষের হৃদয়েই জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি যে এখন বয়সভিত্তিক ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। সাগরিকার চার গোলেই একদিন আগে নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ ধরে রেখেছে নারী সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা।

সোমবার বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে হোটেলে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল ফুটবল দলের। রাতের খাবার শেষ করে ঘুমোতে প্রায় মধ্যরাত। তবে সকাল সকালই সাগরিকাকে উঠতে হয়েছে। তাকে যে একের পর এক ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে কয়েকটি টিভি অফিসে গিয়ে। এমনকি সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় দেওয়া হয়নি তাকে। ইন্টারভিউ শেষ করে বিকেলে হোটেলে ফিরে খেয়েছেন।

নিজের ফুটবল খেলা শুরু, বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে টানা দুইবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবলার হওয়া এবং ফুটবল খেলে অস্বচ্ছ্বল পরিবারে সামান্য অবদান রাখা নিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাগো নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা রফিকুল ইসলামকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সোমবার শেষ হওয়া নারী সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা ফুটবলার সাগরিকা।

জাগো নিউজ : আরেকটি টুর্নামেন্ট, আরেকটি ট্রফি এবং আপনি আবার সেরা খেলোয়াড়। কেমন লাগছে?সাগরিকা : অবশ্যই ভালো লাগছে। আমরা যারা ফরোয়ার্ডে খেলি তাদের লক্ষ্য থাকে গোল করে দলকে জেতানো, সর্বাধিক গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড় হওয়ার।

জাগো নিউজ : এবার তো আপনি সেরা খেলোয়াড় হলেও সর্বাধিক গোলদাতা হতে পারলেন না। মন খারাপ?সাগরিকা : প্রথমত আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, দ্বিতীয়ত আমি সেরা খেলোয়াড় হয়েছি। সর্বাধিক গোলদাতা হতে পারিনি বলে দু:খ তো লাগছেই। তবে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি এবং সেরা খেলোয়াড় হতে পেরেছি তাতে খুশি। সর্বাধিক গোলদাতা হতে পারলে আরও ভালো লাগতো।

নেপাল ও বাংলাদেশ ম্যাচের সবচেয়ে মূল্যবান ফুটবলারের পুরস্কার হাতে সাগরিকা। ছবি:সংগৃহীতনেপাল ও

জাগো নিউজ : লাল কার্ডের কারণেই তো আপনি সর্বাধিক গোলদাতা হতে পারলেন না। এখন কি আপসোস লাগছে?সাগরিকা : আপসোস তো লাগছেই। তিনটি ম্যাচ আমি খেলতে পারিনি। খেললে তো গোল আরও হতো।

জাগো নিউজ : লাল কার্ড পাওয়ার পর ওই রাতটা কেমন ছিল আপনার?সাগরিকা : আমার জন্য কষ্টের রাত ছিল। ঘুমোতে পারিনি। কেননা, আমি জীবনে হলুদ কার্ডও পাইনি, অথচ সরাসরি লাল কার্ড পেয়েছি। অনেক খারাপ লাগছিল। তবে নিজেকে বুঝিয়েছি ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আসলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে এবং ভালো কিছু করতে হবে।

আরও পড়ুন-

মেয়ের খেলা দেখতে ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকার কমলাপুরে সাগরিকার হ্যাটট্রিকে নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের শিরোপা ও গোল উৎসর্গ করেছেন সাগরিকা

জাগো নিউজ : তিন ম্যাচ বসে ছিলেন। তখন আপনার মনে অবস্থা কী ছিল? সাগরিকা : ওই তিন ম্যাচে আমি বাইরে বসেছিলাম। ওরা (সতীর্থরা) যখন মাঠে খেলছিল তখন মনে হয়েছিল মাঠে নেমে আমিও খেলি। এমন একটা ভাব ছিল। আমার কষ্ট হচ্ছিল মাঠের বাইরে থাকায়।

জাগো নিউজ : ম্যাচের পর আপনি বলেছিলেন জেদ থেকেই নেপালের বিপক্ষে ভালো খেলেছেন। তাই বলে জেদের কারণে চারটি গোল করলেন? সাগরিকা : আসলে একজন খেলোয়াড় যখন সুযোগ পায় তখন সে সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। আমার সুযোগ এসেছিল ও কাজে লাগিয়েছি।

জাগো নিউজ : আপনার তো ম্যাচ নিষিদ্ধের পাশাপাশি আর্থিক শাস্তিও হয়েছিল। যদি এমন হতো যে, আপনাকে ম্যাচের শাস্তি না দিয়ে আর্থিক শাস্তি দ্বিগুণ করেছে তাহলে কোনটা ভালো হতো? সাগরিকা : সেটা তো ওনারাই জানতেন। কী শাস্তি হবে আমি তো জানতাম না। তাই অর্থ শাস্তি নিয়ে কোনো আপসোস নেই।

দলের সঙ্গে সাগরিকা (বাঁ দিক থেকে তিনে)। ছবি: সংগৃহীত

জাগো নিউজ : আপনার নাম সাগরিকা কে রেখেছিলেন? সাগরিকা : আমরা দুই ভাই-বোন। আমার বড় ভাইয়ের নাম সাগর। দুই বছরের বড়। তার নাম সাগর রেখেছিলেন আমার নানী। ভাইয়ের নামের সঙ্গে মিল রেখেই আমার নাম সাগরিকা রেখেছিলেন ফুফা। ফুফা আমাকে আদর করে বলেছিলেন সাগরের বোনের নাম সাগরিকা হবে।

জাগো নিউজ : একটা গান আছে ‘আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে, আমি ছুঁয়েছি তোমায়। প্রজাপতি ছুঁয়েছে ফুল, তুমি ছুঁয়েছো আমায়। সাগরিকা বেঁচে আছি তোমারই ভালোবাসায়’। এই গানটি কখনো শুনেছেন?সাগরিকা : হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি। অনন্যা (দলের সহকারী কোচ মাহমুদা আক্তার অনন্যা) ম্যাডাম আমাকে শুনিয়েছেন (হাসি)।

জাগো নিউজ : গতকাল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কী কী করলেন? সাগরিকা : আসলে গতকাল তো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ গেম ছিল। হোটেল ফিরতে এগারোটার মতো বেজেছিল। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমোতে রাত ২টা বেজেছে। সকাল বেলা টিভিতে প্রোগ্রাম ছিল। আসার পর আরেকটা প্রোগ্রাম ছিল। সকালে নাস্তা খাওয়া হয়নি। সকালে একটার পর একটা প্রোগ্রাম করে হোটেলে ফিরে দুপুরে ভাত খেয়েছি।

জাগো নিউজ : আচ্ছা এই যে পাঁচ তারকা হোটেল খাওয়া-দাওয়া করেন কেমন লাগে?সাগরিকা : আসলে এটা অনেক ভালো। আমরা তো কখনো পাঁচ তারকা হোটেলে থাকিনি। এখন খেলার কারণে পাঁচ তারকা হোটেল থাকছি। এটা তো ভালো লাগারই কথা। অনেক ভালো লাগছে।

জাগো নিউজ : এমন একটা পরিবেশে আসার পর এবং এখানে যখন খাওয়া-দাওয়া করে তখন কী বাবা-মায়ের কথা মনে হয়? সাগরিকা : পরিবারের কথা কেন মনে হবে না! অবশ্যই মনে হয়। এমন একটা ভালো জায়গায় আছি আর আমার বাবা-মা গ্রামে থাকেন। আমি যদি ভালো কিছু করতে পারি তাহলে একদিন না একদিন তাদেরও ভালো জায়গায় রাখতে পারবো। পাঁচ তারকা হোটেলে যখন থাকি বাবা-মাকেই বেশি মনে পড়ে।

জাগো নিউজ : নেপালের বিপক্ষে ম্যাচটি দেখতে আপনার বাবা-মা কিংবা পরিবারের কেউ এসেছিলেন?সাগরিকা : বাবা আসতে চেয়েছিলেন। আমি নিষেধ করেছি। কারণ আমার মা অসুস্থ। এজন্য বাবাকে মায়ের কাছে থাকতে বলেছি।

জাগো নিউজ : আপনি ফুটবল খেলে পরিবারের কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছেন কিনা?সাগরিকা : অবশ্যই। কিছু পরিবর্তন তো আসছে। আগে আমার বাবা-মাকে কেউ চিনতেন না, জানতেন না। এখন আমি ভালো কিছু করেছি বলে আমার বাবা-মাকে সবাই সম্মান করেন।

জাগো নিউজ : সম্মানের বিষয়টা তো আছেই। আগে আপনার বাবা-মা যে কষ্ট করে সংসার চালাতেন। সেখানে কোনো উন্নতি হয়েছে? নাকি আগের মতো সেই কাজই করতে হচ্ছে?সাগরিকা : উন্নতি বলতে হচ্ছে, আমার বাবা-মা তো কাজ করেই খান। অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমাদের ডিসি স্যার বাড়িতে ঘরটাই বানিয়ে দিয়েছেন। আমার বাবা-মা এখনো কাজ করেন। আগে আমাদের চায়ের দোকান ছিল। বাবা-মা দুইজনেই চালাতেন। এখন হোটেলটা বন্ধ করে দিয়েছেন। হোটেল চালাতে অনেক কষ্ট হয়, তাই চালান না। এখন বাবা কৃষি কাজ করেন।

জাগো নিউজ : ধন্যবাদ।সাগরিকা : আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরআই/এমএইচ/এএসএম