মেহেদি হাসান উজ্জ্বল
Advertisement
আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের বাসিন্দা এবং ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। নতুনের সন্ধানে শৈশব থেকেই ভ্রমণের প্রতি আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়। সেই মানসিকতা থেকেই শুরু হয় ভ্রমণ। ইচ্ছে ছিল ভালো লাগাকে কাজে লাগিয়ে ভ্রমণের স্মৃতি ধরে রাখা। শুরুর দিকে পরিবার ও বন্ধুমহল নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি জেলা ভ্রমণের পর যেন নেশা তৈরি হয়ে গেলো। সবগুলো জেলা ঘুরতে হবে! এসব ভেবেই শুরু হয় ৬৪ জেলা ভ্রমণের গল্প।
নিজের ভালো লাগা থেকেই ভ্রমণ করা শুরু করেছিলাম। দেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে অভিজ্ঞতা হিসেবে নানা রকমের মানুষের সঙ্গে মেশা, জীবন দর্শন, ইতিহাস, বিচিত্র খাবার নিয়ে জানতে পারার বিষয়টি আজীবন রয়ে যাবে। আমি মনে করি, আমার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কারো যদি ভ্রমণ করার ইচ্ছা হয়; কেউ যদি দেশটাকে নতুন করে জানতে শেখেন, দেখতে শেখেন। তারচেয়ে বড় উপলব্ধি আর কিছুই হতে পারে না। ভ্রমণ আমাদের পুরোনো বিষয়ের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। যে দেশে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা; সে দেশেরও বহু দিক নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। নিজের দেশে ঘুরে উপলব্ধিটা হয়েছে।
আমাদের দেশটা খুব বেশি বড় নয়। তবে বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে কোনো অংশেই কম নয়। খাবার-দাবার কিংবা প্রকৃতিগত ভাবেও আলাদা এক জেলা থেকে আরেকটা। খাবারের ব্যাপারটা যদি বলি, আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের খাবার, খুলনার চুইঝাল, চট্টগ্রামের মেজবান কিংবা পুরান ঢাকার খাবার; একেকটার স্বাদ একদমই অন্যরকম। এ ছাড়া আছে একেক জেলার মিষ্টি খাবারের ভিন্নতা। এমনকি বৈচিত্র্য আছে মানুষের ভাষা, জীবনধারণ ও প্রকৃতিতেও। যখন বিভিন্ন জেলা ঘোরা শেষ হচ্ছিল, আমি নিজেই ভাবতাম এ জেলায় কোনটা আলাদা পেলাম, কোন জিনিসটা অন্য জেলা থেকে ভিন্ন ছিল।
Advertisement
ভ্রমণকালে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতারও শিকার হয়েছি। যাত্রাপথে মানসম্মত খাবার হোটেল না পাওয়া, রাতযাপনের জন্য পরিপাটি হোটেলের অভাব। কয়েকটি জেলায় বাজেটের তুলনায় পরিবেশসম্মত থাকার হোটেল পাইনি। আবার অধিকাংশ হোটেলে ছিল নিরাপত্তার অভাব। এ ছাড়া ছিল লোকাল পরিবহন ব্যবস্থার সংকট। মাঝে মধ্যে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হলেও নিজেকে সামলে এগিয়েছি। অনেক বাধা-বিপত্তির মাঝেও পিছু হটিনি। তাই তো দেশের সবকয়টি জেলা ভ্রমণকারীদের নামের পাশে নিজের নামটি তালিকাভুক্ত করতে পেরে গর্বিত।
নিজের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলেও বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে অনেকদিন কুমিল্লা থাকা হয়েছে। সেই সময়ে কুমিল্লার অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনায় গিয়েছি অসংখ্যবার। পরে নিজের পেশাগত কারণে কক্সবাজার থেকেছি অনেকদিন। সেই সুবাদে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং কক্সবাজারের আনাচে কানাচে গিয়েছি। পরে আবারও পেশাগত কারণে ঢাকার কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জ জেলার শেষপ্রান্তে একটি এড়িয়ায় থাকা হয়। সেখান থেকে জেলা ভ্রমণের একটা বড় ধাপ শেষ হয়।
আরও পড়ুন ঝরনা ও সৈকত ভ্রমণের মধুময় স্মৃতি চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার ভয়ংকর অভিজ্ঞতামূলত ছোটবেলা থেকে ভ্রমণের চিন্তা আসে। সেটি পরে বাস্তবে রূপ নেয় বাংলাদেশের জেলা ভ্রমণ সম্পন্ন করা কয়েকজন ভ্রমণপ্রেমীকে দেখে। নিজের মাঝে জমে থাকা তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং ভ্রমণপ্রেমীদের দেখে অনুপ্রেরণা পাই। আমার মতে, প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বিভিন্ন সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, বিভিন্ন জেলার মানুষের বৈশিষ্ট্যের বৈচিত্র্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য থেকে নতুন কিছু জানতে ও শিখতে সব সময় উৎসুক। পুরো দেশকে জানতে চেয়েছিলাম। দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় যেতে চেয়েছিলাম। বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত-শত পুরাতন ঐতিহাসিক স্থাপনা। সেগুলো দেখাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য।
পরিবার থেকে পুরোপুরি উৎসাহ না পেলেও কখনোই নিরুৎসাহিত করেনি। শুধু বলেছে, যেন সব সময় সর্তকতার সাথে ঘোরাফেরা করি। সেটাই ছিল আমার জন্য আদর্শ বার্তা। আমার জেলা ভ্রমণের অর্জনের সম্পূর্ণ খরচের কিছুটা পরিবার থেকে পেয়েছি। অধিকাংশ অল্প-অল্প করে জমানো টাকা থেকে ব্যয় করেছি। আমার ট্যুর পরিকল্পনা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা নিয়ে সাজাতাম। সে অনুযায়ী ট্যুর প্ল্যান করতাম। এ ছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষ একটা বাড়তি ভূমিকা রাখতো। যেমন শীতের সময়ে উত্তরবঙ্গ বা রংপুর বিভাগ। ফলের মৌসুমে রাজশাহী বিভাগ। বর্ষার মৌসুমে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ভ্রমণ।
Advertisement
আমি ৬৪ জেলায় ভ্রমণকালে গিয়েছি জেলার নামের সাথে মিল থাকা ৩৯টি রেলওয়ে স্টেশনে। অবশিষ্ট ২৫টি জেলার মাঝে কিছু জেলায় কোনো রেলপথ নেই। কিছু জেলায় রেলপথ থাকলেও জেলার নামে নির্দিষ্ট রেলওয়ে স্টেশন ছিল না। ভ্রমণের আরেকটা অংশ হিসেবে সবগুলো রেলওয়ে স্টেশন গিয়েছিলাম। এ ছাড়া অনেক স্মৃতিময় ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মাঝে ছিল বান্দরবানের আফিয়াখুম জলপ্রপাত দেখতে যাওয়া। যেটি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে করেও ৪ বছর পর যেতে হয়েছে। একবার কাছাকাছি গিয়েও না দেখেই ফিরে আসতে হয়েছে প্রাকৃতিক পরিস্থিতির কারণে। ৪ বছর লেগেছিল করোনা মহামারি এবং পাহাড়ি অঞ্চল বলে বিভিন্ন সময়ে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং ভ্রমণসঙ্গীর অভাবে।
দেশের অভ্যন্তরে একমাত্র প্লেন বাদে সব পরিবহনেই ভ্রমণ করেছি। নিরাপদ ভ্রমণযাত্রার মাধ্যম হিসেবে ট্রেন সব সময় আমার কাছে প্রথম পছন্দ। আমি সব সময় দিবস ও সরকারি ছুটি ছাড়া প্ল্যান করতাম বলে ট্রেনেরও পর্যাপ্ত টিকিট পেয়ে যেতাম। আরেকটা সুবিধা পেতাম বিভিন্ন পর্যটন স্পটে। কোলাহলমুক্ত হওয়ায় সাচ্ছন্দ্যে ঘুরে দেখতে পারতাম। আমি সবুজ-শ্যামল দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আরও গভীরভাবে জানতে চেয়েছিলাম। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো নিজ চোখে দেখতে চেয়েছিলাম। সবকিছু মিলিয়েই ৬৪ জেলা ভ্রমণের আগ্রহ জন্মে।
সবশেষে বলতে চাই—অনেকেরই ধারণা, বাংলাদেশে দেখার বেশি কিছু নেই। একসময় এমনটা আমিও ভাবতাম। তবে নিজে ভ্রমণে বেরিয়ে এ ভুল ভেঙেছে। ঐতিহ্য, ইতিহাস কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বাংলাদেশটাই যে সুন্দর; তা ভ্রমণ করলেই যে কারো চোখে ধরা পড়বে। এতটুকু আয়তনের এক দেশেই যে প্রত্যেকটি জেলার মুখের ভাষা, খাবার, পোশাক, জীবনধারায় নানা বৈচিত্র্য আছে—তা এ ভ্রমণ শেষে উপলব্ধি করেছি।
এসইউ/জিকেএ