জাতীয়

ইউনূস স্যার কয়েক বছর থেকে দেশটা সংস্কার করে দিয়ে যাক

ইউনূস স্যার কয়েক বছর থেকে দেশটা সংস্কার করে দিয়ে যাক

‘আন্দোলন চলাকালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য রাস্তা ক্লিয়ার করতে করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২০০ মিটার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন এজেন্সির লোক ছিল। আমরা বুঝতে পারিনি যে তারা রিয়েল বুলেট ছুড়বে। হুট করেই বিজিবি পেছন থেকে গুলি করে। ডান পায়ের হাঁটুর নিচে লাগে। পা কেটে ফেলতে হয়েছে।’

Advertisement

খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলছিল গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রিফাত হাওলাদার (১৭)।

রিফাত এ বছর রাজধানীর বাড্ডার আলাতুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৩ দশমিক ৮৩ পেয়ে পাস করেছে। এখন কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরিবারের অজান্তেই গত বছরের জুলাইয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যায়। তিনদিন গিয়ে ভালো লাগে, তাই চতুর্থদিনও যায়। মানুষের জন্য কাজ করার প্রবল ইচ্ছে তৈরি হয় তার। তাই স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছিল রাস্তায়। কিন্তু কে জানতো, ১৯ ‍জুলাই তাকে ছাড়তে হবে সড়ক?

আরও পড়ুন জুলাই যোদ্ধাদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা থাকছে না দেওয়ালে দেওয়ালে ফুটে উঠছে জুলাইয়ের গ্রাফিতি ঝুলতে ঝুলতে গুলি খাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি আমির জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে যুক্ত ছিল ছাত্রদল ও শিবির

রিফাত হাওলাদার বলে, ‘১৬ জুলাই থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। ১৯ জুলাই মেরুল বাড্ডায় বিজিবির গুলি খেয়ে হাসপাতালে। এরপরে আন্দোলন হয়ে ওঠে সুস্থ হওয়ার। পরিবার জানতো না আন্দোলনে গেছি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর জেনেছে। তারপর থেকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।’

Advertisement

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেলো। আলাতুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এখন কী করবে, জীবনের স্বপ্ন কী?

জবাবে রিফাত বলে, ‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে যে স্বপ্ন ছিল, সেটা এখন আর নেই। স্বপ্ন ছিল পুলিশ হবো। কিন্তু এখন তো আর সেই স্বপ্ন পূরণ হবে না। মানুষের নিরাপত্তা কীভাবে দিবো? আমিই তো নিরাপত্তাহীন। এখন ব্যবসা বা ফ্রিল্যান্সার হওয়ার ইচ্ছে।’

চিকিৎসার চরম অবহেলার চিত্র তুলে ধরে রিফাত বলে, ‘হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় চরম হুমকিতে বা আতঙ্কে ছিলাম। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসা নেই বাড্ডার এইমস হাসপাতালে। পরে ভালো হাসপাতালে রেফার করছে। তখন এএমজেড হাসপাতালে গেছি। তারা রাখে নাই। পঙ্গু হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেওয়ার পর বলল, রগ ছিড়ে গেছে। তারা আবার হৃদরোগ হাসপাতালে পাঠাইছে। ওখানে চিকিৎসা না পেয়ে কল্যাণপুরে ইবনে সিনা হাসপাতালে যাই। শুক্রবার হওয়ায় ওখানে সিনিয়র ডাক্তার না থাকায় আবার হৃদরোগে ফিরে যাই। ওখানে ওটি করছে, কিন্তু গুলি বের করতে পারে নাই। পরে ২০ জুলাই পঙ্গুতে যাই। ২২ জুলাই পা কাটে। ওখানে চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হয়েছি, উন্নতি হয়েছে।’

যেভাবে পাশে দাঁড়ালো ব্র্যাক

রিফাত জানায়, পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় ব্র্যাক লিম্ব অ্যান্ড ব্রেস সেন্টারের (বিএলবিসি) কর্মীরা যান। তারা তখনই আশ্বস্ত করেন, বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজন করে দেবেন। পরে ওই হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ার পর এখানে নিয়ে এসে পা সংযোজন করে দেয়।

Advertisement

শুধু রিফাত নয়, এ পর্যন্ত ৩৪ জনের শরীরে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে উন্নতমানের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করেছে বিএলবিসি। চিকিৎসাসেবা দিয়েছে ১৮৪ জনকে। মানসিক অবস্থার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সহযোগিতা করছে। আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে এই সেবা দেবে বিএলবিসি। এতে তাদের বাজেট ১২ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন গণঅভ্যুত্থান স্মৃতিতে অগ্নিগর্ভ যাত্রাবাড়ী ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ শান্তর মা জুলাই শহীদ পরিবার এককালীন ৩০ লাখ ও মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পাবে উপদেষ্টারা নিচে, সভামঞ্চে শহীদ পরিবারের সদস্যরা ‘কেউ ফোন দিয়ে খোঁজও নেয় না’

দক্ষিণ বাড্ডা নিবাসী রিফাত হাওলাদারদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। যদিও বাড্ডায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। বাবার ভিসা আবেদনের কম্পিউটার দোকান আছে। দুই ভাই, এক বোন। বড় ভাই এইচএসসি পাস করে দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ছোট বোন নার্সারিতে পড়ে। নিজে কৃত্রিম পা নিয়েও এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এটা নিয়েই পড়ালেখা চালিয়ে যাবে সে।

রিফাত বলে, ‘আন্দোলনটা যৌক্তিক বলে যোগ দিছিলাম। কিন্তু এমন দুর্ঘটনা হবে কে জানতো। তবে এখন কেউ ফোন দিয়ে খোঁজও নেয় না। জামায়াতে ইসলামী থেকে সশরীরে বাসায় এসে ২০-৩০ হাজার টাকা দিছে। বিএনপি প্রোগ্রামে নিয়ে ১০ হাজার টাকা দিছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা পাইছি। পরে আর কেউ যোগাযোগ করেনি। কিছু লোককে দ্বিতীয় ধাপে দিছে, আমারও আবেদন করা আছে।’

‘বৈষম্য যায় নাই, ক্ষমতালিপ্সু হয়ে গেছে একশ্রেণির লোক’

আক্ষেপ করে জুলাইযোদ্ধা রিফাত হাওলাদার বলে, ‘একটা দেশকে ১৭ বছরে তিলে তিলে ধ্বংস করেছে। আমরা ছাত্ররা সেটা বাঁচাইতে রাস্তায় নামছিলাম। পূর্ণাঙ্গ চাওয়া বা যেমন দেশ চাই, পাই নাই। রাজনৈতিক দলগুলো যে উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করছে, বন্ধ না হলে ভালো কিছু সম্ভব না। আমরা চাই-দুর্নীতি বন্ধ হোক। আমরা চাই, ইউনূস স্যার কয়েক বছর থেকে দেশটা সংস্কার করে ভালো কিছু করে দিয়ে যাক।’

আরও পড়ুন জুলাইয়ে রণক্ষেত্র ছিল উত্তরা, প্রত্যক্ষদর্শীরা কী বলছেন? ‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’ মামলা না তুললে জুলাই শহীদের সন্তানকে ‘অপহরণের হুমকি’ ‘শেষ দেখা নামাজে, তারপর ইয়ামিন ফিরলেন শহীদ হয়ে’

‘যেই বৈষম্য দূর করতে চাইছিলাম, সেই বৈষম্য যায় নাই। একশ্রেণির লোক ক্ষমতালিপ্সু হয়ে গেছে। আমার চাওয়া, সবাই নিজের কথা বলতে পারবে মন খুলে।’ বলছিল রিফাত হাওলাদার।

রিফাতের মতো ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ৩৬ দিন তৈরি হয়েছে এমন হাজার বিশেক গল্প। যাদের প্রত্যাশা ছিল একটি বৈষম্যহীন ইনসাফের বাংলাদেশ। আজকের বাস্তবতায় সেটি ফিকে হয়ে আসছে।

এসইউজে/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম