রিকশাচালককে বলেছিল পুলিশ

‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ১০ জুলাই ২০২৫
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ গোলাম নাফিজকে রিকশায় করে বহন করে হাসপাতালে নেওয়ার ছবি স্থান পেয়েছে গ্রাফিতিতে। ছবি: সংগৃহীত

গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় যে ছবিগুলো দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে একটি রিকশার পাদানিতে গুলিবিদ্ধ কলেজছাত্র গোলাম নাফিজের মরদেহের ছবি। যে সময় তাকে রিকশার পাদানিতে তুলে দেওয়া হয়, তখনও রড ধরে রেখেছিলেন নাফিজ। এরপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। ওই সময় যে রিকশায় নাফিজকে তুলে দেওয়া হয় সেই রিকশাচালকের নাম নূর মোহাম্মদ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর হতে চললো। নাফিজের বহনকারী রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ সেদিনের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেননি। ৩৫ হাজার টাকায় সেই রিকশাটি লন্ডনপ্রবাসী আহসানুল কবীর সিদ্দিকী কায়সারের কাছে বিক্রি করে দেন তিনি।

এখনো রিকশা চালিয়ে মা, বাবা, বোন, স্ত্রী ও দুই সন্তানের সংসারের খরচ একাই চালান নূর মোহাম্মদ। সরকারের কাছে তার আশা একটি চাকরির। গত ১১ মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কার্যালয়, নগর ভবনসহ বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরলেও চাকরির কোনো আশা তিনি পাননি।

‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’গত বছরের ৪ আগস্ট রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে হাসপাতালে নিয়ে যান রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ। ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের তোলা এই ছবি বহু মানুষকে অশ্রুসিক্ত করেছে।

সম্প্রতি জাগো নিউজের মুখোমুখি হন রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি এবং বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বিষয়েও সরাসরি কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়।

জাগো নিউজ: নাফিজকে কীভাবে রিকশায় তুললেন? সেদিনের ঘটনা জানতে চাই।

নূর মোহাম্মদ: ঘটনাটি ৪ আগস্টের। সেদিন আমি ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে যাত্রী নামিয়ে সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন অনেক গোলাগুলি চলছিল। বারবার ইন্না লিল্লাহ পড়ছিলাম। ফার্মগেট পুলিশ বক্স পার হওয়ার পর বিজ্ঞান কলেজের সামনে পুলিশ গতিরোধ করে। পরে আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। আমি তখন বলি, কোথায় যাবো? ওদিকে গোলাগুলি হচ্ছে, ওদিকে কোথায় যাবো? তখন পুলিশ সদস্যরা বলেন, ‘তোকে আসতে বলেছি আয়।’ এই বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। তখন দোয়া পড়তে থাকি। আমার কাছে মনে হয়েছিল আজ আমি শেষ। আল্লাহ জানে কপালে কী আছে।

এরপর আমাকে নিয়ে বলে এটা রিকশায় তোল। আমি প্রথমে দেখি কিছু টুকরি। পরে তাদের বললাম, এই টুকরিগুলো তুলবো? তখনও খেয়াল করিনি পাশেই একটি ছেলে (নাফিজ) পড়ে আছে। পুলিশ আমাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি দেখছ না? এই যে, এইডা তোল।’ এরপর আমাকে গালাগালি শুরু করে। আমি ওই ছেলের পেছন দিক দিয়ে ধরে উঠানোর চেষ্টা করি আর পুলিশ দুই পা ধরে উঠিয়ে রিকশার পাদানিতে ছুড়ে ফেলে। এ সময় পুলিশ সদস্যরা একজন আরেকজনকে বলতেছে, ‘আরও দুইটা গুলি কইরা দে। বেঁচে যাতে পারে।’ পরে আমাকেও পায়ে গুলি করে দেওয়ার কথা বলে।

‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’শহীদ গোলাম নাফিজের গুলিবিদ্ধ দেহ বহনকারী রিকশা ও এর চালক নূর মোহাম্মদের সঙ্গে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ছবিটি গত বছরের ৭ নভেম্বর জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে তোলা। ছবি: সংগৃহীত

জাগো নিউজ: রিকশায় তোলার পর কী হলো?

নূর মোহাম্মদ: ছেলেটিকে রিকশায় তুলে আমি যখন চালানো শুরু করি তখন দেখি পড়ে যাচ্ছে। তখন পাশের আরেকজন পুলিশ সদস্য এসে বলে, ‘শোয়া তারে’। এরপর দেখি ছেলেটার হাত রিকশার চেইনে আটকে যাচ্ছে। তাই হাতটা টেনে রডের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখি। পরে নাফিজকে নিয়ে একাই আল রাজি হাসপাতালে নিয়ে যাই। এরপর চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে কিছু লোক আমাকে বলে ঢাকা মেডিকেল অথবা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যেতে।

এরপর একটি অটোচালককে অনুরোধ করে বলি ছেলেটাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে যদি বেঁচে থাকে তো ভালো, আর বেঁচে না থাকলে লাশ হাসপাতালে থাকুক। সরকারি হাসপাতাল, পরে বাবা-মা খুঁজে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু ছেলেটার পকেট খুঁজে কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি। সেদিন যদি ছেলেটিকে কেউ ধরে রাখতো হয়তো আমি দ্রুত চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতাম। তাহলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেতো।

‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’শহীদ গোলাম নাফিজের গুলিবিদ্ধ দেহ বহনকারী রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ। ছবি: জাগো নিউজ

চারদিকে বৃষ্টির মতো গোলাগুলি হচ্ছিল, আমি কাকে কী বলবো? কেউ তো ধরতেছে না। একজন সাংবাদিক ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে। তার নাম জীবন আহমেদ। তখন পুলিশ তাকে বলে ক্যামেরাসহ তাকেই পুড়িয়ে দেবে। পরে নাফিজকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই। একদিন পর সোহরাওয়ার্দী থেকে নাফিজের মরদেহ নিয়ে যান তার মামা।

জাগো নিউজ: নাফিজের পরিচয় কীভাবে জানতে পারলেন?

নূর মোহাম্মদ: একদিন পর নাফিজের মামা পত্রিকায় ছবি দেখে ওই পত্রিকায় যোগাযোগ করেন। পত্রিকা অফিস থেকে জীবন আহমেদ রিকশার পেছন থেকে আমার মোবাইল নম্বর নাফিজের মামাকে দেন। এরপর নাফিজের মামা ফার্মগেট এসে আমাকে ফোন দেন। পরে জানতে পারি ছেলেটার নাম নাফিজ। ছেলেটি বেঁচে থাকলে নিজের কাছে আরও ভালো লাগতো।

‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’শহীদ গোলাম নাফিজের গুলিবিদ্ধ দেহ বহনকারী রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ। ছবি: জাগো নিউজ

জাগো নিউজ: সেই রিকশাটি বিক্রি করলেন কেন?

নূর মোহাম্মদ: রিকশাটি চালাতে আমার মন চায়নি। কারণ যখনই রিকশা চালাতে গেছি নাফিজের রক্তাক্ত দৃশ্য আমার মনের ভেতর ভেসে উঠেছে। এজন্য ৩৫ হাজার টাকায় রিকশাটি এক প্রবাসীর কাছে বিক্রি করে দেই। আমি রিকশাটির জন্য ১০, ২০ কোটি টাকা চাইতে পারতাম। কিন্তু আমি তা চাইনি। পরে ওই রিকশাটি জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে দিয়ে দেন ওই প্রবাসী।

জাগো নিউজ: শুনেছি আপনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে চান। কেন?

নূর মোহাম্মদ: আমার ইচ্ছা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে কথা বলার। আমার কাছে গণঅভ্যুত্থানের সময়ের একটা পতাকা আর একটা রাখালের লাঠি আছে। এই দুটি জিনিস আমি তাকে দিতে চাই। এরপর তিনি খুশি হয়ে যা দিতে চান আমি নেবো। একটা সুতা দিলে সুতাই নেবো।

‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’শহীদ গোলাম নাফিজের গুলিবিদ্ধ দেহ বহনকারী রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ। ছবি: জাগো নিউজ

জাগো নিউজ: গত নভেম্বরে রিকশাটি জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে হস্তান্তরের সময় তৎকালীন উপদেষ্টা, বর্তমানে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আপনাকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন?

নূর মোহাম্মদ: এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেননি। ছয়জনের সংসার একাই চালাই। দিনে রিকশা চালিয়ে ৫০০ টাকা ইনকাম করতে কষ্ট হয়। এনসিপির অফিস, নগর ভবন, ঢাকার শিল্পকলাসহ বিভিন্ন জায়গায় গেছি। কিন্তু কেউ কোনো সহযোগিতা করেননি। নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গেও দেখা করেছি কিন্তু আমাকে কোনো সহযোগিতা করেননি।

জাগো নিউজ: আপনি সরকারের কাছে কোনো সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন?

নূর মোহাম্মদ: হ্যাঁ, আমি চাই একটি চাকরি হোক। আমার না হলে ছেলেটার চাকরি চাই। এছাড়া আমার আর কোনো আশা নেই।

‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’শহীদ গোলাম নাফিজের গুলিবিদ্ধ দেহ বহনকারী রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ। ছবি: জাগো নিউজ

জাগো নিউজ: আপনি বলছিলেন আপনার সম্পত্তি দখল হয়েছে। কারা দখল করেছে?

নূর মোহাম্মদ: দিনাজপুরের বীরগঞ্জে মফিজ উকিল নামের একজন আমার পৈতৃক সম্পত্তি দখল করে আছেন। বছরে দুই লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি দেননি। আমাদের কাছে সব কাগজপত্র আছে। কিন্তু এখনো জমি উদ্ধার করতে পারিনি। জমি উদ্ধার করতে ভূমি অফিসসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে গেছি কিন্তু আমাকে কেউ পাত্তা দেয় না। ভোগদখলকারী মফিজ উকিল একসময় আওয়ামী লীগ করতেন। এখন আবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন।

টিটি/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।