ক্যাম্পাস

জুলাই বিপ্লব দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে

জুলাই গণঅভ্যুত্থান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের মেয়ে নুরুল ইজ্জাহ আনোয়ার।

রোববার (২৭ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ‘প্রথম জুলাই বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলনের’ দ্বিতীয় সেশনে এ কথা বলেন তিনি। রিচার্স অ্যান্ড এন্টিগ্রেটেড থট (রিট) ও ঢাবির পলিটিক্যাল সায়েন্স এই সম্মেলনের আয়োজন করে।

নুরুল ইজ্জাহ আনোয়ার তার বক্তব্যের শুরুতে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির জন্য শোক প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেকটা বিপ্লবেই অনেকগুলো প্রেক্ষাপট থাকে। কেবল একটা ঘটনা কোনো বিপ্লব ঘটাতে পারে না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কেবল একটা আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল জাতির নতুন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সূচনা।

তিনি বলেন, আমি দেখছি বাংলাদেশ একটি সংকটকাল পার করছে। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এটা একটা কমন সমস্যা। সম্মিলিতভাবে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে।

জাগরণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শরীফ বান্না বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন তা একটা গোষ্ঠীর কাছ কুক্ষিগত ছিল। বহুদিন ধরেই এই ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তির যে সংগ্রাম, জুলাই বিপ্লব ছিল তার সর্বশেষ সংযোজন। আমাদের কর্তব্য এখন শুধু জুলাইয়ের শহীদদের সম্মান জানানোতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তারা নতুন যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল তা বিনির্মাণে সর্বাত্মক কাজ করা।

তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা দেশকে মুক্ত করেছো। তোমরা দুর্নীতি ও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করবে না। তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করবে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইয়াসিন আখতাই বলেন, গণতন্ত্র আর ইসলামকে সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে ইসলামের সঙ্গে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। যে কারণে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে হুমকি মনে করে। তাই তারা মিশরে মুহাম্মাদ মুরসির শাসনকে মেনে নিতে পারেনি। তুরস্কে আমরা গণতান্ত্রিক উন্নয়নকে সবসময় স্বাগত জানিয়ে আসছি।

আরও পড়ুন

ঢাকায় আনোয়ার ইব্রাহিমের কন্যা নুরুল ইজ্জাহ

সভাপতির বক্তব্যে ঢাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ২০২৪ এর জুলাইয়ে জনগণ একটা পরিবর্তন চেয়েছিল, তারা একটা নতুন বাংলাদেশ চেয়েছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের বহিঃপ্রকাশ। তরুণরা সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

তিনি বলেন, আমি মনে করি তরুণদের সামর্থ্যকে ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশের জন্য এটাই সেরা সুযোগ। আমাদের তরুণরা খুবই মেধাবী। তাদের এই মেধাকে লাজে লাগাতে হলে তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এই জায়গা থেকে তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ঢাবি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমরা যদি আমাদের তরুণদের ক্ষমতায়ন করতে পারি এবং তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি তা বাস্তবায়ন অনেকটাই সহজতর হবে।

এর আগে সম্মেলনের প্রথম সেশনে ঢাবির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এসময় আরও বক্তব্য রাখেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেস্ট ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ জন এফ. ডেনিলোইজ প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, আমরা আজ যে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনের পতন দেখেছি, সেটার নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেককে সামগ্রিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এই শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রে পরিণত করেছিল। শুধু তাই নয় র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সন্ত্রাসের হাতিয়ার বানানো হয়েছিল। গুম-খুন হয়ে উঠেছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ছাত্রনেতাদের অপরাধী হিসেবে জেলে ভরা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মুক্তচিন্তায় বাধা দেওয়া হতো।

জুলাই বিপ্লবের প্রথম আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনকে শুধু আলোচনা নয়, বরং একটি সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বিকৃত ইতিহাস থেকে সত্যকে উদ্ধার করতে চাই। যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের পরিবারের কান্না, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে গেঁথে থাকা গুলির চিহ্ন—এসবই একদিন ন্যায়বিচারের নির্মাণকাজে প্রমাণ হয়ে উঠবে।

এ সময় জন এফ. ডেনিলোইজ বলেন, জুলাই বিপ্লব কোনো বিদেশি শক্তি বা গভীর রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের ফল নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সংগ্রামের ফসল। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের কাছে প্রমাণ দেওয়া কঠিন যে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ এতে জড়িত ছিল না। আজ পর্যন্ত আমি এমন কোনো প্রমাণ দেখিনি। যদি এমন কোনো প্রমাণ কারও কাছে থাকে আমি সেটা দেখাতে চ্যালেঞ্জ করছি।

তিনি আরও বলেন, বিপ্লব সফল হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার অস্থিতিশীল পরিবেশ ও তথ্য যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে যা এখনো চলমান। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৪০০টি প্রবন্ধ জমা পড়ে। এর মধ্যে ৬০টি প্রবন্ধ মৌখিক উপস্থাপনের জন্য ৬০টি পোস্টার মনোনীত করা হয়েছে।

সম্মেলন শেষে টিএসসি অডিটোরিয়ামে ‘লাল জুলাই’ নামক একটি মঞ্চ নাটক পরিবেশন করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

সম্মেলনের দ্বিতীয় সেশনে আরও বক্তব্য রাখেন কোস্টারিকা ইউনিভার্সিটি ফর পিস এর ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. আমর আব্দুল্লাহ, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. লুৎফে সিদ্দিকী, সিঙ্গাপুরের নায়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাইদুল ইসলাম, বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইয়েদা সুলতানা রাজিয়া এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম কবিরুল ইসলাম।

এফএআর/ইএ/এমএস