জাতীয়

ঢাকার প্রকৃতি সংকটে, উন্নয়নের চাপে হারাচ্ছে সবুজ

# ৪৪ বছরে ঢাকায় বনাঞ্চল কমেছে ৩০.৪ বর্গকিলোমিটার# জলাভূমি কমেছে ২২.৬ বর্গকিলোমিটার# নির্মাণ এলাকা বেড়েছে ১২৮.১ বর্গকিলোমিটার# ২৪ বছরে প্রায় ১২ কিলোমিটার বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে# ৯৪.৪ বর্গকিলোমিটার ঘাস/কৃষিভূমি কমেছে

ঢাকার ব্যস্ত নাগরিক জীবনের মাঝে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিত পান্থকুঞ্জ পার্ক। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ হাতিরঝিল পেরিয়ে পান্থকুঞ্জ পার্ক হয়ে পলাশীর দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই নির্মাণকাজের জন্য পার্কটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে কেটে ফেলা হয়েছে অধিকাংশ গাছপালা।

সবুজের স্পর্শ হারিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে এক সময়ের ছায়াঘেরা পার্কটি। বর্তমানে পার্কের ভেতরে এক্সপ্রেসওয়ের একাধিক পিলার স্থাপনের কাজ চলছে। ফলে প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে পার্কটির প্রাকৃতিক পরিবেশ।

শুধু পান্থকুঞ্জ পার্ক নয়, রাজধানী ঢাকায় গত ১৪ বছরে বৃক্ষ আচ্ছাদন এলাকা কমেছে ২ দশমিক ২ কিলোমিটার। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্মাণ এলাকা ১১ দশমিক ৭ থেকে ৫৫ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে ঘাস/কৃষিভূমি ৬০ দশমিক ৩ থেকে কমে ২৩ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার হয়েছে। বৃক্ষ আচ্ছাদন ১৯ দশমিক ৯ থেকে কমে ১০ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। এই এলাকায় জলাশয় প্রায় স্থির রয়েছে, প্রায় ৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার।

আরও পড়ুন

বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস আজ ন্যূনতম জলাধার মান নেই ঢাকার ৪৪ থানার, কমেছে ৬০ শতাংশ জলাধার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো সময়ের দাবি: পরিবেশ উপদেষ্টা দেশে এক বছরে গাছ কাটা কমেছে ৮৪.১ শতাংশ: আরডিআরসি

এই পরিস্থিতিতে আজ (২৮ জুলাই) পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশের প্রাণ-প্রকৃতি দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে। ঢাকায় তো নগরায়ণের ফলে প্রকৃতি বিলীন হচ্ছে। প্রকৃতিকে আইনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে তো হবেই, এরপরও প্রতিটি সরকার ও মানুষের দরদ থাকতে হবে। তবু এই দিবসগুলোতে গাছ লাগানো, নদী পরিষ্কার, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, শিক্ষা কার্যক্রমে উদ্দীপনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে।

পান্থকুঞ্জ পার্কের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন। প্রকৃতি রক্ষার দাবিতে পান্থকুঞ্জ পার্কে টানা ১৬৮ দিন ধরে অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে বিরল প্রতিবাদ গড়ে তোলে তারা।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কারণে সোনারগাঁ হোটেল থেকে এফডিসি পর্যন্ত হাতিরঝিলের এই অংশে পানি আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

রবিবার (২৭ জুলাই) সরেজমিনে দেখা গেছে, এফডিসি মোড়ের পাশের হাতিরঝিল অংশ প্রায় ভরাট। চারদিকের ভরাট মাঝখানে ডোবা হয়ে আছে। এখন সেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে।

আরও পড়ুনযারা খাল দখল করে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না: আমীর খসরু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড সিস্টেম চালু হলে উপকূলীয় কৃষির ক্ষতি কমবে পরিবেশ রক্ষা এখন শুধু নীতির বিষয় নয়, মানবিক দায়িত্ব বছরে জলবায়ুজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার

স্থানীয়রা বলছেন, হাতিরঝিলের জলপ্রবাহ বন্ধ করা যাবে না বলে হাইকোর্টের একটা নির্দেশনা আছে। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে বিগত কয়েক বছরে এই অংশে কাজ চলছে। ওখানকার সব গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। এই এলাকায় বিপুল মশার বিস্তার হয়েছে।

বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব জাগো নিউজকে বলেন, পান্থকুঞ্জ পার্কে আমরা ২০২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৩০ মে পর্যন্ত টানা ১৬৮ দিনের বিরল প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি পালন করি। ‘পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমা: জনগণ বনাম অন্তর্বর্তী সরকার’ নামক গণশুনানির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক নাগরিকের উপস্থিতিতে বিজ্ঞবিচারকগণ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষকে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলে র‌্যাম্প স্থাপন করে প্রকৃতি বিধ্বংসী কাজ রদ করার আদেশ প্রদান করে।

ঢাকার প্রকৃতির অবস্থা

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৪৪ বছরে ঢাকায় বনাঞ্চল ৬৫ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার থেকে ৩৫ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটারে সংকুচিত হয়েছে। সর্বশেষ ২৪ বছরে প্রায় ১২ কিলোমিটার বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে। একই সময়ে ঢাকার ঘাস/কৃষিভূমি ১৬৮ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে ৭৪ দশমিক ৪ বর্গকিলোমিটারে নেমেছে। ২০১০ সালেও ঢাকায় ঘাস/কৃষিভূমি ছিল ১১১ দশমিক ৩ কিলোমিটার, ২০২৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৪ কিলোমিটারে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৪৪ বছরে জলাভূমি ৩৭ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে মাত্র ১৪ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার নির্মাণ এলাকা ১৯৮০ সালে ২০ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার ছিল। ২০২৪ সালে তা বেড়ে ১৪৮ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটারে সম্প্রসারিত হয়েছে। এর জন্য পরিবেশগত মূল্য দিতে হয়েছে।

আরও পড়ুন

গাছের নাম হাজার সন্তানের জননী এবার আষাঢ়ে বৃষ্টিপাত বেড়েছে ১১.৩ শতাংশ, কমেছে ঢাকায় আমরা পরিবেশগত ঝুঁকির গহ্বরে চলে গেছি বছরজুড়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান, তবু কমে না দূষণ

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নির্মাণ এলাকা ৯ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার থেকে ৯৩ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এই এলাকায় ঘাস/কৃষিভূমি ১০৮ দশমিক ৪ থেকে কমে ৫১ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে নেমেছে। বনাঞ্চল ৪৫ দশমিক ৮ থেকে কমে ২৫ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। উত্তর ঢাকায় জলাশয় ৩২ দশমিক ৭ থেকে ১০ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব জাগো নিউজকে বলেন, প্রকৃতি সংরক্ষণের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক স্তর হলো বেহাত হওয়া প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষা করা এবং পরিবেশ ধ্বংস থেকে পুনরায় প্রাণবৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা। বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন অবশিষ্ট গাছ রক্ষা ও নানা প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে প্রকৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু পান্থকুঞ্জ পার্কের প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে গেছে।

সবচেয়ে বেশি বৃক্ষনিধন ঢাকার দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ জানিয়েছে, বৃক্ষনিধন সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে ঢাকার দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। উত্তর সিটির আদাবর (০.০২ বর্গমিটার), রামপুরা (০.৩৮ বর্গমিটার) ও কাফরুলের (০.৩৯ বর্গ মিটার) মতো থানাগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত জনপ্রতি ৯ বর্গমিটার সবুজ স্থানের মান থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। শুধু বিমানবন্দর (৭৭.৮ বর্গমিটার) এবং উত্তরখান (৪৪.৮ বর্গমিটার) এই মান পূরণ করে।

একইভাবে, দক্ষিণ সিটির বংশাল, ওয়ারী ও সূত্রাপুরের মতো অনেক এলাকায় মাথাপিছু সবুজ স্থানের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ বর্গমিটারেরও কম। বেশিরভাগ থানায় জনপ্রতি ৪ দশমিক ৫ বর্গমিটার জলাশয়ের প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের চেয়ে অনেক কম রয়েছে। উত্তর সিটির পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে জলাশয়ের পরিমাণ তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে।

বেড়েছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ জানিয়েছে, ১৯৯০ সালে ঢাকার ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ এলাকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা আদর্শ সীমার (২৬-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) মধ্যে ছিল; ২০২৪ সাল নাগাদ এটি কমে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ এলাকায় দাঁড়িয়েছে। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রার এলাকা ১৯৯০ সালে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ৭৮ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে শহরের কোনো অংশের তাপমাত্রাই ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ছিল না।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসাইন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা গবেষণা করে দেখেছি ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ৬৩ দশমিক ৯১ শতাংশ নির্মাণ এলাকা, সেখানে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ বনাঞ্চল এবং গড় তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একইভাবে রামপুরা ও দারুস সালাম এলাকায় বৃক্ষ আচ্ছাদন অত্যন্ত কম। তাপমাত্রা গড়ে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

এর বিপরীতে সবুজ এলাকাগুলোতে শীতল তাপমাত্রা বেশি দেখা গেছে। উত্তরখান থানায় ২৭ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃক্ষ আচ্ছাদন, ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ নির্মিত এলাকা এবং তাপমাত্রা গড়ে ২৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একইভাবে শাহ আলী ও ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় তাপমাত্রা ৩০ দশমিক ৫ থেকে ৩১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে বলে জানান জাকির হোসাইন খান।

প্রকৃতির অধিকার সম্পর্কিত আইন করতে হবে

জাকির হোসাইন খান জাগো নিউজকে বলেন, প্রকৃতির অধিকারকে লিগ্যালাইজ করতে হবে। এটাকে সংবিধানের অংশ করতে হবে। ঢাকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) অনেক প্রাকৃতিক বন, জলাশয় ও পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা উপেক্ষিত রয়েছে। এটা সংরক্ষণের দায়িত্বে কেউ নেই। তাই এসব অঞ্চলকে আইনগতভাবে সুরক্ষা দিতে ড্যাপ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

তিনি বলেন, আমাদের ইকোলজিকাল অডিট নেই। রিয়েল টাইম কোনো মেজারমেন্ট করা হয় না। ঢাকায় কত গাছ আছে, এটা কেউ বলতে পারে না। আমাদের দূষণ শুরু হওয়ার পর নানা প্রজেক্ট আসে, ততদিনে আর কিছু করার থাকে না। তাই রিয়েল টাইম মনিটরিংয়ের জন্য ইকোলজির অডিট করতে হবে। মানুষকে ন্যাচার ফ্রেন্ডলি করাটা খুব জরুরি। নাহলে আমরা পাকিস্তানের করাচি শহরের মতো হয়ে যাব। সরকার ও জনগণ হলো প্রকৃতির অভিভাবক। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে যে রায়টা হয়েছে সেখানে বলা আছে, যে কোনো প্রাকৃতিক বা পরিবেশগত অধিকার মানবাধিকারের পূর্বশর্ত।

বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজের (বারসিক) পরিচালক পাভেল পার্থ বলেন, নগরায়ণ শুরুর পর থেকেই ঢাকায় বনাঞ্চল, কৃষিভূমি ও জলাধার আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। বিপরীতে, নির্মাণ এলাকা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এই পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি বেড়েছে তাপমাত্রা ও দূষণের মাত্রাও। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঢাকার জীববৈচিত্র্য। অবিলম্বে শহরের বিকেন্দ্রীকরণ আর বাস্তবভিত্তিক পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা না হলে ঢাকার প্রকৃতি আর টিকবে না।

আরএএস/এমএমএআর/জেআইএম