এবার আষাঢ়ে বৃষ্টিপাত বেড়েছে ১১.৩ শতাংশ, কমেছে ঢাকায়

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৮ এএম, ২১ জুলাই ২০২৫

২০২৫ সালের আষাঢ় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে গত বছরের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফেনীতে শুধু একদিনে যে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা মাসজুড়ে হওয়া ঢাকার চেয়ে বেশি। আর জেলা হিসেবে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে সমুদ্রকোলের জেলা কক্সবাজারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার আষাঢ়জুড়ে দেশে মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ৩৯০ মিলিমিটার, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন হাজার মিলিমিটার বেশি। ২০২৪ সালে আষাঢ়ে মোট বৃষ্টিপাত ছিল প্রায় ২৭ হাজার ৩৩০ মিলিমিটার।

সারাদেশে বাড়লেও ঢাকায় অবশ্য কমেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। এ বছর আষাঢ়জুড়ে রাজধানীতে বৃষ্টি হয়েছে ৩২২ মিলিমিটার, যেখানে গত বছর হয়েছিল ৪৪২ মিলিমিটার। একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টি ছিল ৮ জুলাই, ৭৭ মিলিমিটার। অথচ গত বছরের একই সময়ে (১২ জুলাই) একদিনে বৃষ্টি হয়েছিল ১৩১ মিলিমিটার।

এই প্যাটার্ন বদলে যাওয়ার কারণে এখন বৃষ্টিপাত আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়াচ্ছে। একই সঙ্গে অল্প সময়ে অস্বাভাবিকভাবে অনেক বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। যেমন কক্সবাজারে মাত্র সাত দিনেই ৭শ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।- আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে গত বছর ভয়াবহ বন্যা দেখা জেলা ফেনীতে এবারের আষাঢ়ে বৃষ্টি হয়েছে ১০৯৯ মিলিমিটার। শুধু ২৪ আষাঢ় (৯ জুলাই) একদিনেই বৃষ্টি হয়েছে ৩৯৯ মিলিমিটার, যা আষাঢ়ে দেশের সর্বোচ্চ। অথচ গত বছর একই মাসে ফেনীতে একদিনে সর্বোচ্চ ছিল ২০৮ মিলিমিটার।

এবার আষাঢ়ে বৃষ্টিপাত বেড়েছে ১১.৩ শতাংশ, কমেছে ঢাকায়

চলতি বছর আষাঢ়ে সবচেয়ে বেশি ১৪৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজারে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নোয়াখালীতে ১১৩৪ মিলিমিটার।

২০২৪ সালে আষাঢ়জুড়ে কুতুবদিয়ায় ছিল সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড—১৪৩৬ মিলিমিটার। আর একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছিল ৫ জুলাই খেপুপাড়ায়, ২৯২ মিলিমিটার।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবারের বর্ষায় বৃষ্টিপাত দুই ভাবে হয়েছে—একদিকে কোথাও কম বৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে কোথাও হয়েছে অতিভারী বর্ষণ। এটি এ সময়ের জন্য স্বাভাবিক প্যাটার্ন। বিশেষ করে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মতো এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়া উচিত।’

বৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ও ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এখন বৃষ্টি ‘শিপমেন্ট’ হচ্ছে, অর্থাৎ বর্ষার মাঝামাঝি বা শেষভাগে, বিশেষ করে আগস্ট মাসে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। গত বছরও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।- আবুল কালাম মল্লিক

তিনি বলেন, ‘বর্ষার বৃষ্টির প্যাটার্ন এখন বদলে গেছে। আগে বর্ষা শুরু হলে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করার সময়ই একটানা তিন-চারদিন দেশজুড়ে ভারী বৃষ্টি হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেই ধারাবাহিকতা নেই। চলতি বছরের জুন মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় ২১ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে।’

‘এই প্যাটার্ন বদলে যাওয়ার কারণে এখন বৃষ্টিপাত আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়াচ্ছে। একই সঙ্গে অল্প সময়ে অস্বাভাবিকভাবে অনেক বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। যেমন কক্সবাজারে মাত্র সাত দিনেই ৭শ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। ফেনীতেও একদিনে ৩৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে, যা একটি ব্যতিক্রমী মাত্রা।’

এবার আষাঢ়ে বৃষ্টিপাত বেড়েছে ১১.৩ শতাংশ, কমেছে ঢাকায়

বজলুর রশিদ মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় যদি ৪শ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, তাহলে নিচতলা ডুবে যাবে। এটা অসম্ভব নয়। ২০০৯ সালে ঢাকায় একদিনে ৩৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল, তখন পুরো শহরে কোমর সমান পানি উঠে গিয়েছিল। এ ধরনের বৃষ্টি সাধারণত ১০ বছর পরপর একবার হয়।’

আগামী শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির পূর্বাভাস নিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী ২৪ জুলাই সাগরে একটি লঘুচাপের আশঙ্কা রয়েছে, যা নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। এতে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত ঘটতে পারে। শ্রাবণের শেষভাগে, অর্থাৎ আগস্টের শুরুতে কিছুটা কম বৃষ্টি হতে পারে, তবে আগস্টের শেষ দিকে আবারও বৃষ্টি বাড়বে।’

আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘সাধারণত জুলাই মাসই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপ্রবণ মাস হিসেবে পরিচিত। এর পেছনে দুটি প্রধান কারণ রয়েছে—একটি হলো মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা এবং অন্যটি বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের সৃষ্টি।’

তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর সমানভাবে লঘুচাপ বা নিম্নচাপ হয় না। কোনো বছর কম হয়, কোনো বছর বেশি। সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, বর্ষাকালে অতিভারী বৃষ্টির প্রবণতা কমে গেছে, বরং হালকা ও মাঝারি বৃষ্টির প্রবণতা বেড়েছে।’

গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা বেশি। শ্রাবণ মাসেও এবছর স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

এবার আষাঢ়ে বৃষ্টিপাত বেড়েছে ১১.৩ শতাংশ, কমেছে ঢাকায়

আবুল কালাম মল্লিক মনে করেন, বর্ষার বৃষ্টিতে বৈশ্বিক ও স্থানীয় পর্যায়ে পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ও ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এখন বৃষ্টি ‘শিপমেন্ট’ হচ্ছে, অর্থাৎ বর্ষার মাঝামাঝি বা শেষভাগে, বিশেষ করে আগস্ট মাসে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। গত বছরও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।’

‘মৌসুমি বৃষ্টিপাতের বিস্তার এবং সংঘটনের সময় এখন আর স্বাভাবিক নয়। যে সব সিস্টেমের কারণে বৃষ্টি হয়, সেসব সিস্টেমেও পরিবর্তন আসছে। বায়ুর আবর্তন ও গতির মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে স্থানীয়ভাবে বৃষ্টিপাতের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে।’

এই আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, ‘সারা পৃথিবীতেই বৈশ্বিক তাপমাত্রার প্রবণতা বাড়ছে, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। ইউরোপজুড়ে এবার ইতিহাসে সর্বোচ্চ গরম পড়ছে, আমেরিকায় হঠাৎ আকস্মিক বন্যা হচ্ছে। পাকিস্তানে বন্যায় এ পর্যন্ত দুশ’র বেশি মানুষ মারা গেছে। সব কিছু আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে গেছে।’

আরএএস/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।