জাতীয়

গ্রাহকের অনীহা, অলস পড়ে আছে ২৬১১২৫ প্রি-পেইড মিটার

বিদ্যুতের দুই লাখ ৬১ হাজার ১২৫টি প্রি-পেইড মিটার অলস পড়ে আছে। গ্রাহকরা এই মিটার গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছেন না। প্রি-পেইড মিটারে বেশি বিল উঠবে ভেবে অনেকে মিটার গ্রহণ করছেন না। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেনা এসব মিটার পরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। ফলে বিপুলসংখ্যক মিটার এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রতিটা মিটার কিনতে সরকারকে গুনতে হয়েছে ৪৩ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার ২৬৩ টাকা (ডলারপ্রতি ১২২ টাকা ৪০ পয়সা হিসাব করে)।

১০ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহককে স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারের আওতায় আনতে ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অব বিপিডিবি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ৬১৯ কোটি ৩০ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। প্রকল্পের আওতায় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ সাত লাখ ৩৭ হাজার ৩৩৩টি স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার কেনা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৪ লাখ ৭৬ হাজার ২০৮টি স্থাপন করা হয়েছে।

এ অবস্থায় গ্রাহককে সঠিকভাবে বুঝিয়ে অলস পড়ে থাকা স্মার্ট প্রি-পেইড মিটারের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। প্রকল্প নিয়ে নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে এমন মতামত দিয়েছে তারা।

প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১৬৯ কোটি ৬৫ লাখ ১০ হাজার টাকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণসহায়তা থেকে ৩২৮ কোটি ৮৭ লাখ ৩৩ হাজার এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ১২০ কোটি ৭৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন নেসকোর প্রি-পেইড মিটারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান ঠাকুরগাঁওবাসীর প্রি-পেইড মিটার স্থাপন থেকে সরে আসতে সরকারকে আলটিমেটাম সিলেটে বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার ও গ্রাহক হয়রানি বন্ধে মানববন্ধন

যেসব এলাকার গ্রাহক এই মিটারের আওতায় আসবে সেগুলো হলো- চট্টগ্রাম জেলার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, সীতাকুন্ড, হাটহাজারী ও পটিয়া উপজেলা, কক্সবাজারের সদর উপজেলা, বান্দরবানের সদর উপজেলা, রাঙ্গামাটির সদর উপজেলা, খাগড়াছড়ির সদর উপজেলা, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলা, ফেনীর সদর উপজেলা, কিশোরগঞ্জের সদর, বাজিতপুর ও ভৈরব উপজেলা, টাঙ্গাইলের সদর উপজেলা, ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা এবং সিলেট সিটি করপোরেশন। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বাবিউবো) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণে উঠে এসেছে, প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭০ দশমিক ২২ শতাংশ স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার সংগ্রহ করা হয়েছে। তাছাড়া গ্রাহকদের স্মার্ট প্রি-পেইড মিটারের প্রতি অনাগ্রহ এবং নেতিবাচক ধারণা থাকার কারণে দুই লাখ ৬১ হাজার ১২৫টি মিটার প্রকল্পের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হলেও স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পের আওতায় স্থাপনের আগে স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে গ্রাহকের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির প্রয়োজন ছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে পিএসসি এবং পিআইসি সভার সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পিএসসি ও পিআইসি সভা সম্পাদন করা হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান করা যেত।

আবার প্রকল্পের এক্সিট প্লান সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জড়িত ব্যক্তিদের ওই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন ছিল। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) সংস্থান থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক ও বিপিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মোজাহারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ একটু স্লো হয়েছে। মাঝখানে স্টুডেন্ট মুভমেন্ট হয়েছে, এছাড়া সরকার পরিবর্তন। অনেকে মনে করছে এটা আওয়ামী লীগের আমলের মিটার পরে সমস্যা হবে, বেশি বিল উঠবে, এসব কারণ দেখিয়ে অনেকে মিটার নিচ্ছে না। কিছু কিছু গ্রাহক সঠিক সময়ে বিল পরিশোধ করতে চান না। কিন্তু প্রি-পেইড মিটারে বিল দেরিতে পরিশোধের উপায় নেই। এসব কারণে অনেকে অনীহা দেখাচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত মানুষেরাও প্রি-পেইড মিটার নিতে অনীহা দেখায়।

মোজাহারুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রি-পেইড মিটার নিয়ে অনেকের ভুল ধারণা আছে। উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও ভুল ধারণা আছে। টাকা বেশি কাটে। ডিমান্ড চার্জ বেশি কাটে। তবে ১ কিলোওয়াটে ৪২ টাকা ডিমান্ড চার্জ কাটে। এটা সরকারের নির্ধারিত বিল।’

আইএমইডি জানায়, ২ লাখ ৬১ হাজার ১২৫টি স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার (সিঙ্গেল ফেজ ও থ্রি-ফেজ) স্থাপনের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে দ্রুত কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারের লাইফ টাইম ১০ বছর পরবর্তী ব্যবস্থাপনা (নষ্ট মিটার অপসারণ, সংরক্ষণ ও নতুন মিটার প্রতিস্থাপন ইত্যাদি) সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বস্তরের জনগণকে স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলার জন্য প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা গ্রহণসহ অন্য সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের পাশাপাশি সৃষ্ট সুবিধাদি টেকসই করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন প্রি-প্রেইড মিটারের টাকা শেষ, স্কুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ বিদ্যুতের ৫ লাখ স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার কিনছে সরকার বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটারে গ্রাহকের ‘ডিজিটাল’ ভোগান্তি

চলমান প্রকল্পে ৫৪১ কোটি ১৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৯২ টাকার ১২টি অডিট আপত্তি রয়েছে। প্রকল্প দপ্তর থেকে প্রত্যেকটি অডিট আপত্তির বিপরীতে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ব্রডশিটে জবাব পাঠানো হলেও অডিট আপত্তিগুলো অনিষ্পন্ন রয়েছে।

আইএমইডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অব বিপিডিবি’ প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছি। প্রকল্পের সারসংক্ষেপ সংশ্লিষ্ট বিভাগে পৌঁছে দিয়েছি। তারা আমাদের সুপারিশ মোতাবেক কাজ করছে। দুই লাখ ৬১ হাজার ১২৫টি প্রি-পেইড মিটার সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু গ্রাহক এখনো গ্রহণ করেনি। এই বিষয়েও আমাদের মতামত দিয়েছি। প্রকল্পের কিছু ব্যয়ের বিষয়ে অডিট আপত্তি দেখেছি, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।’ প্রথমে প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, বিদ্যমান পোস্ট-পেইড মিটারিং সিস্টেমে যথাসময়ে বিল পরিশোধ না করায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ মিটারিং পদ্ধতিতে সিস্টেম লস তুলনামূলকভাবে বেশি। এছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে অনুমোদিত লোডের চেয়ে বাড়তি লোড ব্যবহার এবং মিটার টেম্পারিং রোধের সুযোগ নেই। স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার সিস্টেম লস কমানো যাবে, অন্যদিকে যথাসময়ে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের মাধ্যমে শতভাগ রাজস্ব আদায়ও সহজ হবে। আবার গ্রাহকের অনুকূলে বরাদ্দ করা লোডের অতিরিক্ত লোড ব্যবহার করা হলে মিটার টেম্পারিং সংকেত দেওয়ার মাধ্যমে লোড বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সম্ভব হবে।

প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে ১০ লাখ ২০ হাজার সিঙ্গেল ফেজ স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার স্থাপন, ৩০ হাজার থ্রি-ফেজ স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার স্থাপন, ৮ হাজার ৮৩১টি এনক্লোজার বক্সসহ ডাটা কনসেন্ট্রেটর ইউনিট স্থাপন, ২৫টি প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের জন্য হ্যানন্ড হেল্ড এবং ৮ হাজার ৮৮১টি তথ্যভান্ডার ও ভোক্তার সেবা দেওয়া। প্রকল্পের অর্থ ব্যয় হলেও অনেক কাজ এখনো অধরাই রয়ে গেছে।

এমওএস/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম