দেশজুড়ে

খোলস পাল্টে সক্রিয় আওয়ামিপন্থিরা!

‘রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) কর্মচারী সংসদ’ ব্যাংকটিতে কর্মরত আওয়ামীপন্থি কর্মচারীদের সংগঠন। বিগত সরকারের সময় দীর্ঘ ১৬ বছর দলীয় প্রভাব খাটিয়ে সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন রাকাবের প্রধান কার্যালয় কার্যত জিম্মি করে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির নেতাদের বিরুদ্ধে ঘুস, দুর্নীতি, বদলি বাণিজ্যসহ রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গত বছরের ৫ আগস্ট রাজশাহীতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রকাশ্যে হামলা চালানোরও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংগঠনটির হাতে রাকাবের প্রধান কার্যালয় এখনো জিম্মি। সারাদেশের প্রতিটি ব্যাংকসহ সরকারি অফিস-আদালত অনেকটা দোসরমুক্ত হলেও রাকাবের প্রধান কার্যালয়ে আওয়ামীপন্থিদের পূর্ণ প্রভাব থাকায় বিএনপি-জামায়াতপন্থি কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে।

অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী মহানগর বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার ইন্ধনে ফ্যাসিবাদী এই সংগঠন কিছুদিন আগে নতুন করে পুনর্গঠন করা হয়েছে। আগের কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বাদে বাকি প্রায় সবাইকে দিয়ে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। কমিটিতে পদ পাওয়া কর্মচারীরা নিজেদেরকে ‌‘বিএনপি-জামায়াতপন্থি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা চেষ্টা চালাচ্ছেন।

‘২০০৯ সালে রাকাব শ্রমিক সংসদ শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সংগঠনটির নেতারা দীর্ঘ ১৬ বছর জাতীয়তাবাদী আদর্শের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার ও জুলুম চালান। অনেককে চাকরিচ্যুত, হয়রানিমূলক বদলি, হুমকি-ধমকিসহ নানাভাবে নির্যাতন করেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ৫ আগস্টের পরেও সংগঠনটি ফ্যাসিস্ট হাসিনার হয়ে রাকাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন ও জুলুম করেন তারা।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দীর্ঘ এক যুগ ধরে শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত ‘রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কর্মচারী সংসদ’ ব্যাংকে একক আধিপত্য বজায় রেখেছিল। ঘুস, দুর্নীতি, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এই সংগঠনের বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিভাগীয় শ্রম দপ্তর, রাজশাহীর এক পত্রে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট এ সংসদের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে নির্ধারিত সময় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রিটার্ন দাখিল না করায় তা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন: শ্রমিক লীগ নেতাকে পেয়ে উত্তেজিত জনতার মারধর, ভিডিও ভাইরালআওয়ামী লীগ বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না: সালাহউদ্দিনমাদকাসক্ত অবস্থায় রাসিকের সাবেক কাউন্সিলর গ্রেফতারকলকাতা অফিস থেকে দেশবিরোধী কার্যকলাপ শুরু করেছেন শেখ হাসিনামুসলমান নয়, বাংলাদেশে হিন্দুরাই হিন্দুদের শত্রু: গয়েশ্বর

আশ্চর্যের বিষয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় এক বছর পর চলতি বছরের ২২ মে হঠাৎ করেই এই কর্মচারী সংসদ পুনরায় সচল ঘোষণা করে বিভাগীয় শ্রম দপ্তর। ওই দিনের (২২ মে) এক পত্রে এই অনুমোদন দেওয়া হয়, যা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

শ্রমিক লীগের অঙ্গসংগঠন রাকাব কর্মচারী সংসদের একটি কর্মসূচিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমিক লীগের অঙ্গসংগঠন রাকাবের এই শ্রমিক সংসদের আগের কমিটির সভাপতি হাসিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক ফরিদ হোসেন সংগঠনটিকে নতুন করে সচল করার ফন্দি আঁটেন। তারা আগের কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক-১ রায়হান আলীকে নতুন কমিটির সভাপতি, দপ্তর সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামানকে সহ-সভাপতি-১ করে বেশ কয়েকজন আওয়ামী ঘরানার কর্মচারীর সমন্বয়ে রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার সহায়তায় কর্মচারী সংসদটি পুনরায় সচল করেন।

আগের কমিটির সভাপতি হাসিবুল ইসলাম রাজশাহী মহানগর জাতীয় শ্রমিক লীগের শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং সাধারণ সম্পাদক ফরিদ হোসেন মহানগর জাতীয় শ্রমিক লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, যা ব্যাংকে দলীয় প্রভাব বজায় রাখার প্রমাণ হিসেবেই দেখছেন অনেকেই। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বর্তমান শ্রমিক সংসদের কমিটি পুনর্গঠন হওয়ায় রাকাবজুড়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

‘রাকাবের জাতীয়তাবাদী কর্মচারী পরিষদ রয়েছে, যেটি বিগত সময় আওয়ামী সরকারের দমন-পীড়নে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। আমরা এটিকে সক্রিয় করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই মহানগর বিএনপির কিছু শীর্ষ নেতার ইন্ধনে আওয়ামী ঘরানার ফ্যাসিবাদী সংগঠন শ্রমিক সংসদকে পুনর্গঠন করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের হামলার একটি ভিডিও ফুটেজ এই প্রতিবেদকের হাতে আসে। এই হামলায় আগের কমিটির সভাপতি হাসিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিনকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, এই দুই নেতাসহ বর্তমান কমিটির অনেককেই জাতীয় শ্রমিক লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূটিতে অংশ নিতেও দেখা গেছে। অথচ তাদের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সংগঠন ‘শ্রমিক সংসদ’ এর নাম ও রেজিস্ট্রেশন ব্যবহার করে আওয়ামী ঘরানার কর্মচারীদের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করে রাকাবের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দাপটের সঙ্গে চলছেন।

 

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খায়রুজ্জামান লিটনকে ফুলের নৌকা উপহার দিচ্ছেন আগের কমিটির রাকাব নেতারা (চিহ্নিত)

আরও পড়ুন: আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের বিচার চেয়ে রাবি ছাত্রদলের বিক্ষোভগণঅভ্যুত্থান দিবসে সরকারি কর্মসূচিতে আ’লীগ নেতা-মামলার আসামি!এক বছরেও আমরা কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পাইনি: সারজিসশেখ পরিবার এবং আওয়ামী লীগ কর্মীরা একঝাঁক কাপুরুষ: প্রেস সচিবসুযোগ পেলে ৫৪ বছরের ইতিহাসই বদলে দেবে জামায়াত: ডা. তাহের

এ বিষয়ে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন রাকাব শাখার সভাপতি গোলাম মোর্শেদ জাগো নিউজকে বলেন, “জাতীয়বাদী শ্রমিক ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী শ্রমিকদের জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনার বিষয়। ফ্যাসিবাদী সংগঠন ‘শ্রমিক সংসদ’ এর নামে নতুনভাবে আওয়ামী লীগের এই ফ্যাসিবাদ চক্র রাকাবে রাজত্ব করে চলেছে। আমরা এর অবসান চাই।”

রাকাবের জাতীয়তাবাদী কর্মচারী পরিষদের সভাপতি শারিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৯ সালে রাকাব শ্রমিক সংসদ শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সংগঠনটির নেতারা দীর্ঘ ১৬ বছর জাতীয়তাবাদী আদর্শের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার ও জুলুম চালান। অনেককে চাকরিচ্যুত, হয়রানিমূলক বদলি, হুমকি-ধমকিসহ নানাভাবে নির্যাতন করেন। তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ৫ আগস্টের পরেও সংগঠনটি ফ্যাসিস্ট হাসিনার হয়ে রাকাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন ও জুলুম করেন। এ নিয়ে নগরীর শাহমখদুম থানায় ফৌজদারি মামলাও চলমান। এরপরও মামলা থেকে বাঁচতে ও নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে বিএনপিতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে এবং সফলও হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গত ১৮ মে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরে সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধে আবেদন করি। কিন্তু তিন দিনের মাথায় এই সংগঠনের নামে নতুন কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়, যা খুবই দুঃখজনক।’

রাকাব কর্মচারী সংসদের আগের কমিটি

রাজশাহী মহানগর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতারাও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক রফিক উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাকাবের জাতীয়তাবাদী কর্মচারী পরিষদ রয়েছে, যেটি বিগত সময় আওয়ামী সরকারের দমন-পীড়নে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। আমরা এটিকে সক্রিয় করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই মহানগর বিএনপির কিছু শীর্ষ নেতার ইন্ধনে আওয়ামী ঘরানার ফ্যাসিবাদী সংগঠন শ্রমিক সংসদকে পুনর্গঠন করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা বলেন, ‘যতটুকু শুনেছি, শ্রমিক লীগের রাকাবের ওই সংগঠন (শ্রমিক সংসদ) বর্তমানে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন দখল করে নিয়েছে। এর বেশি কিছু আমি জানি না।’

এসআর/জেআইএম