গত ৯ সেপ্টেম্বর টিভিতে নেপালের জেনজির আন্দোলনের খবর দেখে ২০২৪ ঢাকার জুলাই বিপ্লবের কথা মনে ভেসে এসেছিল। ঐ মুহূর্তে নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম উত্তেজনাপূর্ণ। সেদিন প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি আচমকা পদত্যাগ করেছেন।
কিছুদিন আগে সরকার কর্তৃক একাধিক সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম যেমন ফেসবুক, এক্স, টুইটার, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বিশেষত এর কারণে জেনজি কিশোর তরুণ প্রজন্ম বিক্ষোভে নামেন। বাধার সুকঠিন উচ্চতায় পুলিশকে গুলি চালাতে হয়, যার ফলে অন্তত ১৯ জন নিহত হন।এই গণহত্যার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবন, রাজনৈতিক নেতাদের আবাস ও প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত করেন। জনসাধারণের অসন্তোষ চরমে পৌঁছায়। এরপর বিমানবন্দর বন্ধ করা হয়, কারফিউ জারি হয়, আর সেনা ও পুলিশ শান্তির ডাক দেয়। সেসব বৈষম্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সমাধান আনতে বলেছেন তিনি। অতিরিক্ত অরাজকতায় অর্থমন্ত্রী বিশ্বনু প্রসাদ পাওডেলও তার নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলেন।
ভিডিও ফুটেজে আরো দেখা যায়, অর্থমন্ত্রীকে নেতালোভাগ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন, জনতা তাকে ঘিরে ধরে ধাওয়া করছে, এবং কিছু বিক্ষোভকারী তাঁকে থাপ্পড় ও পা দিয়ে আক্রমণ করছে। যা দেখতে অনেকটা খারাপ লেগেছে। তবে তরুণপ্রজন্ম এখন বৈষম্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক আক্রোশের বিরুদ্ধে সরব।তাদের ক্ষোভ আজ দেখা যায় অর্থমন্ত্রীর এমন অসহায় পরিস্থিতিতে। এছাড়া অর্থমন্ত্রীর প্রতি জনগণের ক্ষোভ আজ স্পষ্ট হয়েছে এই আন্দোলন কেবল কাঠমান্ডুর ভবানীগঞ্জ নয়, এটি প্রতিটি গলি, চওড়া রাস্তা, এবং নেপালের হৃদয় জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
সমসাময়িক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায় তরুণ প্রজন্ম আজকাল হয়ে উঠেছে নতুন ইতিহাসের নির্মাতা। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঢাকার রাস্তায় যে তরুণরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মশাল জ্বালিয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা আজ ২০২৫ সালে কাঠমান্ডুর জেন-জি’র জন্য হয়ে উঠেছে অনুসরণযোগ্য মডেল। ঢাকার আন্দোলন কেবল একটি প্রতিবাদ ছিল না। এটি ছিল সামাজিক ন্যায্যতা, সমতা ও অন্তর্ভুক্তির এক সুসংগঠিত সংগ্রাম। আর তাই কাঠমান্ডুর তরুণেরা শিখেছে বৈষম্য ভাঙতে হলে শুধু স্লোগান নয়, চাই সৃজনশীল কৌশল, প্রযুক্তি ভিত্তিক সংগঠন আর অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব।
ঢাকার জুলাই আন্দোলনটি ছিল একাধিক স্তরে অনন্য। প্রথমত, এটি ডিজিটাল ও অফলাইন প্ল্যাটফর্মের যুগল প্রয়োগ ঘটিয়েছিল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তরুণরা বৈষম্যবিরোধী বার্তা ছড়িয়েছে, হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড তৈরি করেছে। সেই সঙ্গে শাহবাগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, এমনকি বস্তি পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় গান, নাটক, দেয়ালচিত্র আর ফ্ল্যাশমব আয়োজন করে আন্দোলনকে জনমানুষের কাছে টেনে এনেছিল। দ্বিতীয়ত, আন্দোলনের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র ছিল নজরকাড়া। নারী, ট্রান্সজেন্ডার, প্রতিবন্ধী, শ্রমজীবী শ্রেণি সবাই ছিল এই আন্দোলনের সক্রিয় অংশ।
এই মডেলই ২০২৫ সালে কাঠমান্ডুর তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। নেপালের সামাজিক বাস্তবতায় জাতপাতের বৈষম্য, নারী-পুরুষের অসাম্য, শিক্ষায় বৈষম্য ও পরিবেশ সংকট প্রবল। কিন্তু কাঠমান্ডুর জেন-জিরা বুঝেছে ঢাকার মডেলের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আর ডিজিটাল সংহতি তৈরি না করলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের আন্দোলন আজ আর দেশভিত্তিক নয়। এটি এক আন্তঃদেশীয় ধারা। আজকের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ঢাকার অভিজ্ঞতা কাঠমান্ডুকে অনুপ্রাণিত করছে, আবার কাঠমান্ডুর অভিজ্ঞতা ঢাকার তরুণদের নতুন করে সাহস দেবে। বৈষম্যের দেয়াল ভাঙতে এই পারস্পরিক শিক্ষা ও সংহতিই একদিন সমগ্র অঞ্চলকে সমতার পথে নিয়ে যাবে।
ঢাকার জুলাই আন্দোলনের আরেকটি শিক্ষা হলো রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে তরুণদের ঐক্য গড়ে তোলা। বাংলাদেশে যেখানে প্রতিটি ইস্যু দলীয়করণে আটকে যায়, সেখানে জুলাই আন্দোলন ছিল দলমুক্ত, তরুণদের সার্বজনীন কণ্ঠস্বর। কাঠমান্ডুতেও তরুণরা চেষ্টা করছে সেই ধারা বজায় রাখতে কোনো একক সংগঠনের পতাকায় নয়, বরং নেটওয়ার্কভিত্তিক ঐক্যের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলছে।
এখানে অবশ্যই বহু চ্যালেঞ্জ আছে। নেপালের মতো দেশেও রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক অনীহা আর সামাজিক কুসংস্কার তরুণদের প্রতিবাদকে দুর্বল করতে চায়। কিন্তু ঢাকার অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছে যদি আন্দোলনের ভেতর সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও অন্তর্ভুক্তির সমন্বয় থাকে, তবে দমন করে রাখা যায় না।
২০২৫ সালের কাঠমান্ডুর এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আসলে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ শক্তির পারস্পরিক অনুপ্রেরণার প্রতিফলন। ঢাকার জুলাই মডেল দেখিয়েছে, কীভাবে একটি শহর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অগ্নিশিখা জ্বালাতে পারে। কাঠমান্ডুর তরুণরা সেই শিখা হাতে নিয়ে আজ নিজেদের সমাজে সমতার নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
কাঠমান্ডু জেন-জিদের বৈষম্য ভাঙার আন্দোলন কতটুকু সফলতার সাথে কাজ করতে পারে তা সময় বলে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় বৈষম্য এক গভীর শেকড় গেড়ে বসা সমস্যা। দুর্নীতি, জন্ম, জাতপাত, ধর্ম, লিঙ্গ, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা শিক্ষার সুযোগ সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের নানা রূপ আমরা দেখতে পাই। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে জেন-জিদের নেতৃত্বে যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সাহসী ও সময়োপযোগী উদ্যোগ। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় এই আন্দোলন আসলেই কতটুকু কাজ করতে পারে?
প্রথমেই স্বীকার করতে হবে, কাঠমান্ডুর তরুণ প্রজন্ম বৈষম্যের প্রশ্নে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা শুধু রাস্তায় মিছিলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইন, ইউটিউব ভিডিও, পথনাটক, দেয়ালচিত্র এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী বার্তা ছড়িয়েছে।সরকারের দুর্নীতিবিরোধীতার সাথে তারা নারী, দলিত ও শ্রমজীবী তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করে আন্দোলনকে তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র দিয়েছে। এই দিক থেকে আন্দোলনের নৈতিক সাফল্য ইতোমধ্যেই স্পষ্ট।
কিন্তু বাস্তব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। প্রথমত, নেপালের সামাজিক কাঠামোতে জাতপাত ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এতটাই গভীরে প্রোথিত যে তা রাতারাতি ভাঙা সম্ভব নয়। আন্দোলন মানুষের মানসিকতা বদলাতে শুরু করতে পারে, কিন্তু আইন, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে চাপ সৃষ্টি না করলে টেকসই সমাধান আসবে না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মতো নেপালেও রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই তরুণদের আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। এতে আন্দোলনের মৌলিক শক্তি ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, অনলাইন-নির্ভর অ্যাকটিভিজমের সীমাবদ্ধতা রয়েছে লাইক-শেয়ারের ঝড় সৃষ্টি হলেও বাস্তব জীবনে পরিবর্তন ঘটাতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ দরকার।
তবুও আশা করার যথেষ্ট কারণ আছে। তরুণদের আন্দোলন ইতিহাসে বারবার পরিবর্তনের সূচনা করেছে। বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের অবদান, হংকংয়ের প্রজন্মের গণতন্ত্রপ্রীতি, অথবা যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন সবই প্রমাণ করে তরুণদের সংগঠিত শক্তি সমাজকে বদলাতে সক্ষম। কাঠমান্ডুর আন্দোলনও হয়তো তাৎক্ষণিক সব বৈষম্য দূর করতে পারবে না, তবে এটি নিঃসন্দেহে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবিকে জোরদার করবে।
বলা যায়, কাঠমান্ডু জেন-জিদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আপাতত: আংশিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে। এটি সমাজের ভেতরে সচেতনতার বীজ বপন করবে, তরুণদের মধ্যে সমতার মূল্যবোধ জাগ্রত করবে এবং নীতি নির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। তবে টেকসই পরিবর্তনের জন্য দরকার আন্দোলনকে ধারাবাহিক রাখা, রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখা, এবং আইনি সংস্কার ও সামাজিক সচেতনতার সমন্বয় ঘটানো।
কাঠমান্ডুর তরুণ প্রজন্মের এই উদ্যোগ শুধু কঠোর প্রতিবাদ নয়। এটি ভবিষ্যতের কল্যাণের জন্য বিনিয়োগ। আজ তারা হয়তো পুরো বৈষম্যের প্রাচীর ভাঙতে পারবে না, কিন্তু আগামী প্রজন্মের জন্য ফাটল ধরিয়ে দেবে। আর সেই ফাটলই একদিন সমতার নতুন সমাজ গড়ার ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের আন্দোলন আজ আর দেশভিত্তিক নয়। এটি এক আন্তঃদেশীয় ধারা। আজকের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ঢাকার অভিজ্ঞতা কাঠমান্ডুকে অনুপ্রাণিত করছে, আবার কাঠমান্ডুর অভিজ্ঞতা ঢাকার তরুণদের নতুন করে সাহস দেবে। বৈষম্যের দেয়াল ভাঙতে এই পারস্পরিক শিক্ষা ও সংহতিই একদিন সমগ্র অঞ্চলকে সমতার পথে নিয়ে যাবে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/এমএস