হাসপাতালের করিডোরে শুয়ে কাঁদছিলেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। পাশে বসে কাঁদছেন তার স্ত্রী। দুজনের চোখের পানি ছোট্ট একটি হাত দিয়ে মুছে দিচ্ছে এক শিশু। সে জানে না—এই কান্নার মানে কী। জানে না, যার জন্য তারা কাঁদছে—সে আর ফিরবে কি না।
মাত্র তিন বছরের ছোট্ট শিশু আদিব দগ্ধ ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদার ছেলে। তার বাবা তখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন। নুরুলের শরীরের শতভাগ পুড়ে যায় আগুনে। তার স্ত্রী গর্ভবতী; আর মাত্র ১০ দিন পরই পরিবারে নতুন অতিথি আসার কথা। কিন্তু এখন সেই অপেক্ষা শুধুই বিষাদে মোড়া।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরিবারের সবাই এসেছে হাসপাতালে। কেউ কাউকে বোঝাতে পারছেন না। সবাই কান্নাকাটি করছেন।
বড় পুত মইরা গেছে কারেন্টে, ছোটডা পুইড়া গেলো আগুনে। এখন আল্লাহ্ আমারে আর কীসের পরীক্ষা দেবো? হাঁটতে পারি না, ল্যাংড়া হইয়া গেছি। নাতিডা কয়—বাবা মজা লইয়া আইতেছে। ও জানে না, ওর বাবা আর কোনোদিন ফিরবে না...।—নুরুল হুদার বাবা আব্দুল মনসুর
বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, করিডোরে শুয়ে-বসে আছেন বেশ কয়েকজন। এরমধ্যে তিন বছরের একটি ছোট্ট শিশু এদিক-ওদিক দৌড়ে খেলা করছে।
তখন সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিশুটি দগ্ধ ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদার ছেলে। নুরুলের বাবা শুয়ে আছেন, মা ও নুরুলের দুই বোন বসে আছেন। তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও শুয়ে ছিলেন। পাশে আরও বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজন।
আরও পড়ুন
মৃত্যুর কাছে হার মেনে চলে গেলেন ফায়ার ফাইটার শামীমশতভাগ দগ্ধ ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদাও চলে গেলেনদগ্ধ ফায়ার ফাইটারদের চিকিৎসা দিতে ঢাকায় সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক
দগ্ধ ফায়ার ফাইটারদের উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে ঢাকায় উড়ে এসেছেন সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বুধবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দিকে শতভাগ আগুনে পুড়ে যাওয়া ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদা মারা যান। এ মৃত্যু যেমন মেনে নেওয়ার নয়; তেমনই নুরুলের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর এখন কী হবে, পরিবারটি কীভাবে চলবে, তা-ও জানে না কেউ।
এই ভাইটা আমাদের বাবা-মায়ের শেষ সম্বল ছিল। বড় ভাই মরার পর ছোট ভাইটাকে ঘিরেই সব স্বপ্ন ছিল। এখন সেই ভাইটিও আর নেই....। ভাইয়ের স্ত্রী পোয়াতি, আমি তাকে কীভাবে বলবো ভাইটার অবস্থা?—নুরুল হুদার বড় বোন রোকসানা বেগম
একটি পরিবার যখন ছারখারময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার ধামাইল গ্রামের ছেলে নুরুল হুদা। বছর তিনেক আগে নুরুলের বড় ভাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি এবার আগুনে পুড়ে মারা গেলো।
নুরুল হুদার বাবা আব্দুল মনসুর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জাগো নিউজকে বলছিলেন, ‘বড় পুত মইরা গেছে কারেন্টে, ছোটডা পুইড়া গেলো আগুনে। এখন আল্লাহ্ আমারে আর কীসের পরীক্ষা দিবো? হাঁটতে পারি না, ল্যাংড়া হইয়া গেছি। নাতিডা কয়—বাবা মজা লইয়া আইতেছে। ও জানে না, ওর বাবা আর কোনোদিন ফিরবে না...।’
পাশে বসে থাকা নুরুলের মা তখন শুধু ছোট সন্তানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অপলক দৃষ্টিতে। তার চোখ দিয়ে ঝরছিল অশ্রু।
নুরুল হুদার মামা অধ্যাপক আলমগীর কবির। তিনি পরিবারের সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কথা হলে জাগো নিউজকে বলেন, ‘চিকিৎসকরা স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, শতভাগ বার্ন হলে পৃথিবীর কোনো চিকিৎসায় আর কিছু করার থাকে না; শুধু আল্লাহ্ পারেন।’
ডাক্তাররা কইছিল নিশ্বাস নেওয়ার ওইখানে একখান রগ আছে। সেটা পুইড়া গেছে। আমার ছয়ডা পোলা আর একডা মাইয়া। শামীমই আমারে সবচাইতে বেশি ভালাবাসাতো। শামীমের এক ছেলে, দুই মেয়ে।—শামীম আহমেদের মা রাজভানু
তিনি বলেন, ‘নুরুলের স্ত্রীর গর্ভে আরেকটি সন্তান। ১০ দিন পর প্রসব। অথচ স্বামী পাশে থাকবেন না—সেই হাহাকারই এখন শ্বাসরুদ্ধ করে তুলছে পুরো পরিবারকে।’
বড় ভাইটা মরার পর ছোট ভাই অবলম্বননুরুল হুদার বড় বোন রোকসানা বেগমের কণ্ঠে ছিল শুধুই হাহাকার। জাগো নিউজকে বলছিলেন, ‘এই ভাইটা আমাদের বাবা-মায়ের শেষ সম্বল ছিল। বড় ভাই মরার পর ছোট ভাইটাকে ঘিরেই সব স্বপ্ন ছিল। এখন সেই ভাইটিও আর নেই....। ভাইয়ের স্ত্রী পোয়াতি, আমি তাকে কীভাবে বলবো ভাইটার অবস্থা?’
নুরুলের আগে চলে যান শামীমগতকাল মঙ্গলবার মারা যান আরেক ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদ। তারও শরীরের শতভাগ আগুনে পুড়ে যায়। মঙ্গলবার শামীম মারা যাওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে হাসপাতালে কথা হয় সত্তরোর্ধ্ব শামীমের মা রাজভানুর সঙ্গে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শামীমের মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডাক্তাররা কইছিল নিশ্বাস নেওয়ার ওইখানে একখান রগ আছে। সেটা পুইড়া গেছে। আমার ছয়ডা পোলা আর একডা মাইয়া। শামীমই আমারে সবচাইতে বেশি ভালাবাসাতো। শামীমের এক ছেলে, দুই মেয়ে।’
শামীমের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা টঙ্গী ফায়ার স্টেশনের আবাসিকে থাকতাম। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করছি। খাওয়া শেষে শামীম অফিসে রুমে যায়। এমন সময় হঠাৎ ফায়ারের ঘণ্টা বেজে ওঠে।’
সহকর্মীর বর্ণনায় মর্মান্তিক মুহূর্তআগুন নেভানোর সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ফায়ার ফাইটার সাইফুল ইসলাম। তিনি আহত চার ফায়ার ফাইটারকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। উদ্ধার করতে গিয়ে তার হাতের তালুতেও আগুনের তাপ লেগে ফোসকা পড়ে গেছে।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে কথা হয় ফায়ার ফাইটার সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি আগে গুদামের ভেতরে ভিডিও করতে যাই। ভিডিও করে বাইরে এসে স্যারদের বলি, ভেতরে আগুন ফুটতেছে। তখন স্যাররা ভেতরে দেখতে যান কীসের আগুন। যেতেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে।’
তিনি বলেন, ‘চারজনকে টেনে বের করি। দুজনের মুখ ছাড়া পুরো শরীর সঙ্গে সঙ্গেই পুড়ে যায়। মাত্র এক মিনিট আগে বিস্ফোরণ হলে হয়তো কেউ দগ্ধ হতেন না।’
আরও পড়ুন
‘তথ্য গোপনের ফাঁদে’ বারবার মৃত্যুর মিছিলে ফায়ার ফাইটাররাটঙ্গীতে দগ্ধ ফায়ার সার্ভিসের ৪ কর্মী জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে
ঘটনাস্থলের গুদামটি ছিল বেশ বড়, কিন্তু প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য ছিল মাত্র একটি সরু গেট। সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বাইরে থেকে বোঝার উপায় ছিল না এটি কেমিক্যালের গুদাম। ভেতরে বিপজ্জনক পদার্থ থাকলেও কোনো সতর্কবার্তা বা বাড়তি নিরাপত্তা ছিল না।’
ঢাকায় সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদগ্ধ ফায়ার ফাইটারদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকায় আসেন সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. চং সি জ্যাক। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি তিনি জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে যান এবং রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালের পরিচালক ও চিকিৎসক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। আহতদের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা সম্পর্কেও খোঁজখবর নেন সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক।
বেঁচে রইলো দুই ফায়ার ফাইটারগত ২২ সেপ্টেম্বর বিকেলে টঙ্গীতে রাসায়নিকের একটি গুদামের আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের চার কর্মী দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে দুজন ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদ ও নুরুল হুদার শরীরের শতভাগ দগ্ধ হয়। একদিনের ব্যবধানে মারা যান দুজন। এখন বেঁচে রয়েছেন বাকি দুজন। তারা হলেন ৪২ শতাংশ দগ্ধ অফিসার খন্দকার জান্নাতুল নাঈম ও ৫ শতাংশ দগ্ধ ফায়ার ফাইটার জয় হাসান।
নিহতদের পরিবারের পাশে থাকার প্রত্যয়ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জাগো নিজকে বলেন, ‘নিহত ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদ ও নুরুল হুদার পরিবারের পাশে থাকবে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচের দায়িত্বও আমাদের।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া প্রাথমিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিহত দুজনের পরিবারকে আর্থিক সহয়তা দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় অর্থ নিহত দুই পরিবারকে শিগগির দেওয়া হবে।’
টিটি/এমকেআর/জেআইএম