মতামত

আচার, সংহতি ও পরিচয়ের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ

দুর্গাপূজা দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে (পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, আসাম, ত্রিপুরা ও ওড়িশা) কেবল একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক জটিল সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এটি আধ্যাত্মিক ভক্তির ক্ষেত্র ছাড়িয়ে সমাজের গভীর স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক সংহতি, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যায়। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, দুর্গাপূজা হলো এক বহুমুখী আয়না, যা দেখায় কীভাবে ঐতিহ্য, ক্ষমতা এবং আধুনিকতা পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে একটি সমাজের কাঠামো ও গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে।

দুর্গাপূজার মূল ভিত্তি দেবী দুর্গার মহিষাসুরের উপর বিজয়ের পৌরাণিক আখ্যান। এই আখ্যানটি শুধু একটি ধর্মীয় গল্প নয়, এটি সৃষ্টির নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতীক—অশুভের উপর শুভের জয়, বিশৃঙ্খলা ও অন্যায়ের উপর শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা। সমাজতত্ত্বে, এই আখ্যানটি একটি সাংস্কৃতিক নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে, যা সমাজের নৈতিক ও সামাজিক নিয়মাবলি মেনে চলার প্রেরণা দেয়। দেবী দুর্গা, যিনি নারী শক্তির প্রতীক, তিনি কেবল পূজিত নন, বরং তিনি সমাজের নিয়ন্ত্রক শক্তি এবং নৈতিক বিচারকের প্রতিচ্ছবি।

ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল দুরখেইমের কার্যকারিতা তত্ত্ব (Functionalism) অনুযায়ী, দুর্গাপূজা সামাজিক সংহতির একটি শক্তিশালী মাধ্যম। উৎসবের প্রস্তুতির শুরু থেকে—যেমন স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ, প্যান্ডেল নির্মাণ, প্রতিমা স্থাপন—এবং সমাপ্তি পর্যন্ত—যেমন সম্মিলিত আরতি ও বিসর্জন—প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান মানুষের মধ্যে সমবায় চেতনা (Cooperation) সৃষ্টি করে। এই সম্মিলিত অংশগ্রহণ এক ধরনের 'সম্মিলিত উচ্ছ্বাস' (Collective Effervescence) তৈরি করে, যেখানে ব্যক্তিগত আবেগ সমষ্টিগত অভিজ্ঞতায় বিলীন হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া ব্যক্তি এবং বৃহত্তর সমাজের মধ্যে একটি গভীর নৈতিক বন্ধন প্রতিষ্ঠা করে, যার মাধ্যমে সামাজিক আদর্শ ও নিয়মাবলি বার্ষিক চক্রে পুনরায় সমর্থিত ও দৃঢ় হয়। পূজা হয়ে ওঠে সমাজের 'পূজনীয় প্রতীক' (Sacred Symbol), যা সম্প্রদায়ের ঐক্যকে মূর্ত করে এবং সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।

দুর্গাপূজার একটি বিশেষত্ব হলো এর শৈল্পিক প্রকাশ, যা মূলত 'থিম পূজা'-র মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্যান্ডেলের থিম, মণ্ডপের স্থাপত্য, প্রতিমার নির্মাণশৈলী এবং এর সঙ্গে যুক্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা—এসবই স্থানীয় এবং সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক প্রগাঢ় প্রকাশ। এই থিমগুলি প্রায়শই সামাজিক, রাজনৈতিক বা পরিবেশগত বার্তা বহন করে, যা উৎসবকে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীতে রূপান্তরিত করে।

পিয়েরে বুর্দিউর সাংস্কৃতিক পুঁজির তত্ত্ব অনুযায়ী, এই শৈল্পিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বা পৃষ্ঠপোষকতা করা সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তির প্রদর্শনের একটি মাধ্যম। থিম প্যান্ডেলের জটিলতা, ব্যবহৃত উপকরণের গুণগত মান, প্রতিমার শৈল্পিক নৈপুণ্য বা আধুনিক/ঐতিহ্যবাহী শৈলীর ব্যবহার—এগুলো কেবল ধর্মীয় অনুরাগ নয়, বরং সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক জ্ঞান, নান্দনিক বোঝাপড়া এবং সামাজিক গৌরব প্রদর্শন করে। শহুরে পরিবেশে, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও নান্দনিকতা এই উৎসবের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, যা ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক স্বীকৃতি ও বৈধতা লাভে সহায়তা করে। পূজা কমিটিগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা কার্যত এক ধরনের 'প্রতীকী সংঘাত' (Symbolic Struggle), যেখানে বিজয় সামাজিক অবস্থানকে দৃঢ় করে।

দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি এক বিশাল অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র, যা প্রথা এবং আধুনিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করে। এই উৎসব শিল্পকর্ম, ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও করপোরেট স্পন্সরশিপের সমন্বয়ে একটি গতিশীল বাজার তৈরি করে।

অ্যান্থনি গিডেন্সের কাঠামোবাদী তত্ত্ব অনুসারে, দুর্গাপূজা দেখায় যে কীভাবে ঐতিহ্যবাহী প্রথা সমাজের কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হয় (অর্থনৈতিক বাজার ও করপোরেট পুঁজি) এবং সেই কাঠামোও নতুন সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে (থিম ও স্পন্সরশিপের মাধ্যমে) পুনরায় উৎপাদিত হয়। করপোরেট স্পন্সরশিপ, গণমাধ্যমের প্রচার এবং পর্যটন এই উৎসবকে আধুনিকীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ এবং বৈশ্বিকীকরণের প্রভাবযুক্ত এক জটিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে। পূজা তাই শুধু ধর্মীয় ব্যয় নয়, এটি এক ধরনের 'উপভোগের অর্থনীতি' (Economy of Consumption) তৈরি করে, যা গ্রামীণ শিল্প (যেমন মৃৎশিল্প) এবং শহুরে বাণিজ্যের মধ্যে এক নতুন আর্থ-সামাজিক যোগসূত্র তৈরি করে। এই অর্থনৈতিক কাঠামো প্রদর্শন করে যে ধর্মীয় আচারগুলি কীভাবে আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় টিকে থাকে এবং এর অংশ হয়ে ওঠে।

দুর্গাপূজা কেবল একটি বার্ষিক ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি জটিল সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার, ব্যক্তিগত পরিচয় ও সামাজিক সংহতির, অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক মূল্যবান ক্ষেত্র, যা দেখায় কীভাবে আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক সংহতি, পরিচয় নির্মাণ, সাংস্কৃতিক পুনরুৎপাদন এবং সামাজিক স্তরকে প্রভাবিত করে।

নগর জীবনে দুর্গাপূজা সামাজিক স্থান (Social Space) এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। শহরের পাড়া বা অঞ্চলগুলো তাদের প্যান্ডেলকে সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে এক তীব্র স্থানীয় একতা (Local Solidarity) সৃষ্টি করে।

প্রতীকী মিথস্ক্রিয়া তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই অস্থায়ী মণ্ডপগুলি নগর জীবনের বিচ্ছিন্নতা দূর করে জনগণের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এই স্থাপনাগুলি এক ধরনের 'তৃতীয় স্থান' (Third Place) বা অস্থায়ী সম্প্রদায়ের (Temporary Community) জন্ম দেয়। প্যান্ডেলের অবস্থান এবং তার থিমের মাধ্যমে তারা তাদের স্থানীয় পরিচিতি বা 'পাড়া'-র গৌরব এবং সামাজিক সামর্থ্যকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে। এই প্রকাশ শুধু ধর্মীয় অনুরাগের প্রতিফলন নয়, বরং সামাজিক অর্থবোধ, গোষ্ঠীগত পরিচয় নির্মাণ এবং অর্থায়ন প্রক্রিয়ার প্রতীকী প্রকাশ। উৎসবের এই অস্থায়ী কাঠামো ব্যবহার করে নগর পরিসরের দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি ভেঙে যায় এবং এক সাময়িক সময়ের জন্য স্বেচ্ছাচারী আনন্দের (Carnivalesque) পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

দুর্গাপূজা লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতা এবং নারীর প্রতীকী অবস্থানের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেবী দুর্গা হলেন নারীর শক্তি (শক্তি তত্ত্ব), সুরক্ষা এবং ন্যায়ের সর্বোচ্চ প্রতীক, যা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রতীকীভাবে চ্যালেঞ্জ করে।

তবে, প্রতীকী আধিপত্যের পাশাপাশি উৎসবের বাস্তব সামাজিক আচারে একটি গভীর দ্বৈততা লক্ষ্য করা যায়। যদিও প্রতীকীভাবে নারীশক্তিকে পূজা করা হয়, কিন্তু উৎসবের সাংগঠনিক, আর্থিক ও নীতিনির্ধারক নেতৃত্বে সাধারণত পুরুষদেরই প্রাধান্য থাকে। অন্যদিকে, ঘরোয়া পূজা, রন্ধন, আলপনা এবং অন্যান্য প্রথাগত দায়িত্বে নারীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই দ্বৈততা দেখায় যে কীভাবে সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান একইসঙ্গে লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে (দেবীর মূর্তির মাধ্যমে) এবং ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গ-ভূমিকাগুলোকেও বজায় রাখে (বাস্তব সংগঠনের মাধ্যমে)। এটি নারীকে একইসঙ্গে 'পূজনীয় দেবী' এবং 'সামাজিক নিয়ন্ত্রণে' রাখার এক সূক্ষ্ম কৌশল।

প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য দুর্গাপূজা সাংস্কৃতিক স্মৃতি এবং সামাজিক বন্ধন সংরক্ষণের একটি অপরিহার্য মাধ্যম। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের কল্পিত সম্প্রদায়ের তত্ত্ব অনুসারে, দুর্গাপূজা ভৌগোলিকভাবে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি সম্প্রদায়কে একত্রিত করে। এই উৎসব প্রবাসে তাদের আত্মপরিচয় পুনর্নির্মাণে এবং মূলভূমির সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রবাসী পূজাগুলো প্রায়শই 'বাঙালিয়ানা' রক্ষার এক প্রতীকী সংগ্রাম হিসেবে কাজ করে, যা অভিবাসী প্রজন্মের কাছে ঐতিহ্য ও ভাষাকে জীবন্ত রাখে। এটি কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং বৈশ্বিক বাঙালি সংস্কৃতির এক স্থিতিস্থাপক প্রদর্শনী।

উৎসবটি ঐক্যের প্রতীক হলেও, এটি বিদ্যমান সামাজিক স্তর ও বৈষম্যকেও প্রতিফলিত করে। কার্ল মার্কসের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ অনুসারে, প্যান্ডেলের প্রতিযোগিতার মাত্রা, স্পন্সরশিপের ধরণ এবং জনসমাগমের প্রকৃতি প্রায়শই আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতার কাঠামোর ভিন্নতাকে স্পষ্ট করে তোলে। বড় ও থিম-ভিত্তিক পূজাগুলো সমাজের উচ্চবিত্তের আর্থিক ও সামাজিক আধিপত্যকে প্রতীকীভাবে প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে ছোট ও স্থানীয় পূজাগুলো সীমিত সম্পদের সঙ্গে সংগ্রাম করে। দুর্গাপূজা তাই সামাজিক শক্তির কাঠামো এবং সম্পদ বিতরণের একটি আয়না, যা বিদ্যমান শ্রেণি বিভাজনকে প্রতিফলিত করে।

সাম্প্রতিককালে পরিবেশগত প্রভাব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক আলোচনার বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিমা নির্মাণে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পেইন্ট ব্যবহার এবং বিসর্জনের ফলে জলজ পরিবেশের দূষণ—এই প্রথাগত আচারকে পরিবেশগত ও নৈতিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানায়। এই সংঘাতটি দেখায় যে কীভাবে ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক আচারগুলি আধুনিক পরিবেশগত এবং নৈতিক চাপের মুখে পরিবর্তিত হতে বাধ্য হচ্ছে। জীব-বৈচিত্র্য বান্ধব উদ্যোগ এবং সচেতনতা কর্মসূচিগুলো পরিবেশগত পরিবর্তনের সঙ্গে সামাজিক আচারের সমন্বয়ের উদাহরণ।

দুর্গাপূজা কেবল একটি বার্ষিক ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি জটিল সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার, ব্যক্তিগত পরিচয় ও সামাজিক সংহতির, অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক মূল্যবান ক্ষেত্র, যা দেখায় কীভাবে আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক সংহতি, পরিচয় নির্মাণ, সাংস্কৃতিক পুনরুৎপাদন এবং সামাজিক স্তরকে প্রভাবিত করে। দুর্গাপূজা দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান সামাজিক জীবনের জটিলতা ও বৈচিত্র্যকে ফুটিয়ে তোলার এক নিখুঁত উদাহরণ, যেখানে সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান সমাজকে আকার দেয় এবং সমাজও এই আচার-অনুষ্ঠানকে নতুন আকার প্রদান করে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/জেআইএম