মতামত

‘আল্লাহ তুই দেহিস’—সমগ্র সমাজের এক আর্তনাদ

নাপিতের অবদান নিয়ে আসলে আমাদের যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। আমরা স্কুলে পড়েছি—মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলো চাকা, আগুন কিংবা বিদ্যুৎ। কেউ কেউ আবার বলে মুদ্রণযন্ত্র, কেউ বলে ইন্টারনেট। অথচ সত্যি বলতে কী, এসবের চেয়েও বড় আবিষ্কার হলো নাপিত। হ্যাঁ, নাপিত না থাকলে মানুষ আজও জটা পাকানো, দাড়িতে কাক-পাখির বাসা বাঁধা, গলার নিচে কচ্ছপ-খোলস ঝোলানো এক ভয়ংকর প্রজাতি হয়ে থাকতো।

নাপিত শব্দের একটি সমার্থক শব্দ হচ্ছে—নরসুন্দর। চুল-দাড়ি-গোঁফ ছেঁটে নর তথা মানুষকে সুন্দর করে তোলেন তারা—এ জন্য তাদের বলা হয় নরসুন্দর। ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এই পেশার সঙ্গে বেশি যুক্ত ছিলেন। তাদের বলা হতো ‘শীল’। এখন অবশ্য সব ধর্মের মানুষই কাজটি করছেন সম্মানের সঙ্গে। একজন নরসুন্দর কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবেই বিশেষ কিছু গুণের অধিকারী হন।

প্রথমত, তিনি প্রচণ্ড বিশ্বাসযোগ্য একজন মানুষ। আপনি নিশ্চিন্তে তার ক্ষুরের নিচে নিজের মাথাটা দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারেন। সাধারণত তাদের সৌন্দর্যবোধ থাকে প্রবল। আপনার মুখের গড়ন দেখে বুঝে নিতে পারেন কোন স্টাইলে চুল, দাড়ি বা গোঁফ ছাঁটলে আপনাকে ঠিক মানাবে, অধিকতর সুদর্শন লাগবে। অধিকাংশ নরসুন্দরের রসবোধ ও বাচনভঙ্গি হয় দারুণ আকর্ষণীয়। কথার পিঠে কথা জুড়ে অনর্গল গল্প বলতে পারেন তারা। ফলে সেলুনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও খদ্দেরের মনে বিরক্তি আসে না।

আজ চুল-দাড়ি, কাল হয়তো পোশাক, আর পরশু হয়তো চিন্তাই কেটে দেওয়া হবে। যে সমাজ এভাবে সবাইকে এক ছাঁচে ফেলতে চায়, সে সমাজ আসলে নিজের মাথাটাই হারিয়ে ফেলছে। হ্যাঁ, যে সমাজে মানুষকে জোর করে চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়, সে সমাজ শেষ পর্যন্ত বুঝতেই পারবে না—কে নাপিত, কে পাগল, আর কে আসল মানুষ।

ইতিহাসে রাজদরবারের নাপিতদের গুরুত্ব ছিল রাজমন্ত্রীর চেয়েও বেশি। রাজা যদি সপ্তাহে একবার দাড়ি না কাটতেন, প্রজারা ভাবত সিংহাসনে নিশ্চয়ই ভূত বসেছে। ফলে নাপিতরা ছিলেন রাজকীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সমান মর্যাদাপ্রাপ্ত। একেকজন নাপিত ছিলেন একেকজন ‘রাজনৈতিক উপদেষ্টা’—কারণ তিনি জানতেন, রাজা আসলে কতটা চাপের মধ্যে আছেন। আজও সেই ধারা বজায় আছে—চাকরির ইন্টারভিউ, প্রেমিকার সঙ্গে দেখা কিংবা ভোট চাইতে যাওয়া—সব কিছুর ভাগ্য নির্ধারণ করে নাপিতের কাঁচি।

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরে এই পেশার জন্ম। তখন তারা শুধু চুলই কাটতেন না, দাঁত তুলতেন, ফোঁড়া কাটতেন, এমনকি ছোটোখাটো সার্জারিও করতেন। তাই তাদের নাম ছিল ‘বার্বার সার্জন’ বা নাপিত শল্যবিদ!

প্রযুক্তি যতই আসুক, নাপিতের কাঁচি এখনো অপরাজেয়। ইলেকট্রিক ট্রিমার, শেভার, রেজার—এসব কেবল গৃহস্থালি পর্যায়ের খেলনা। আসল শিল্পকলা কেবল নাপিতের হাতে। নাপিতের হাতে কাঁচি মানে অস্ত্রোপচারের মতো নিখুঁত শল্যকৌশল। তবে মাঝেমধ্যে তিনি গাল কেটে দিয়ে সামান্য ‘বোনাস স্মৃতিচিহ্ন’ রেখে দেন, যেটাকে অবশ্য শিল্পের অংশই বলা যায়।

ভারতীয় উপমহাদেশে তো নাপিতরা একপ্রকার ‘জীবনচক্র-পরামর্শক’। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে— সব গুরুত্বপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি অপরিহার্য। মুসলিম সমাজেও নাপিতের ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয়। খতনা করানো, বর সাজানো, কুলখানিতে মাথা মুড়িয়ে দেওয়া—এসব কাজের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন নাপিত। তিনি একপ্রকার জীবনচক্র-পরামর্শক। দুনিয়ায় ডাক্তার আছে, উকিল আছে, কিন্তু নাপিত ছাড়া আপনি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত টিকতে পারবেন না।

তাই বলা যায়, সভ্যতার চাকা যেভাবে পৃথিবী ঘুরিয়েছে, নাপিতের কাঁচি সেভাবেই সভ্যতার মুখ পরিষ্কার করেছে। আমরা দাড়ি-চুলে বাঘমামার মতো ঘুরে বেড়াই না, এ কৃতিত্ব নাপিতের। আসলে তাদের নাম হওয়া উচিত ‘মানবসৌন্দর্যের প্রধান প্রকৌশলী।’ ইতিহাসে যাদের নাম নেই, অথচ আয়নায় তাকালেই আমরা তাদের অবদান দেখি।

এই প্রসঙ্গ হঠাৎ কেন টানলাম? কারণ সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে এক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, দুজন লোক একজন বৃদ্ধকে টেনেহিঁচড়ে বসিয়ে তার লম্বা চুল আর দাড়ি কেটে দিচ্ছেন। বৃদ্ধ লোকটি হাল ছেড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘আল্লাহ তুই দেহিস।’ ক্যামেরার লেন্স কাঁপছে, আশপাশে লোকজন দাঁড়িয়ে অট্টহাসি হেসে উঠছে, আর দুজন স্বঘোষিত তাওহিদী-হাইজিন-বীর এক হাতে ট্রিমার, আরেক হাতে মানবিকতার পতাকা উড়িয়ে বলছেন, ‘আমরা সেবা করছি।’

সেবার সংজ্ঞা বোধহয় পাল্টে গেছে। আগে মানুষকে চিকিৎসা দিলে, ক্ষুধার্তকে খাওয়ালে, গৃহহীনকে আশ্রয় দিলে সেটাকে সেবা বলা হতো। এখন সেবার মানে হলো—লোকজনকে টেনে এনে চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া, জোর করে গোসল করানো, তারপর ইউটিউবে আপলোড করে বিজ্ঞাপনের টাকা রোজগার করা। মানবতা এখন মনিটাইজড।

আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কাশিগঞ্জ বাজারে। ভুক্তভোগী হালিম উদ্দিন আকন্দ, যিনি ৩৪ বছর ধরে জটা চুল ও দাড়ি রেখেছিলেন। তিনি সাধু-সন্ন্যাসীর বেশে ঘুরতেন, ঝাড়ফুঁক করতেন, তাবিজ দিতেন, ওষুধ দিতেন। এলাকার একেবারেই পরিচিত লোক ছিলেন। একদিন কিছু লোক মোটরসাইকেলে এসে তাকে রোগীর নামে ডেকে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে তিনি বের হলেন, আর বাজারের মাঝেই বসে গেল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ‘ট্রিমিং সেশন।’

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যত আবিষ্কার আছে—চাকা, আগুন, বিদ্যুৎ—সবকিছুকে হার মানিয়েছে একটি যন্ত্র: চুল কাটার মেশিন। কারণ, একে দিয়ে শুধু চুল-দাড়ি নয়, মানুষের পরিচয়ও কেটে ফেলা যায়। আপনি যদি একে ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, তবে পাবেন—এটি হচ্ছে ‘তাওহিদী ট্রিমার।’ বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করলে—এটি ‘জীবাণুনাশক যন্ত্র।’ আর রাজনীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করলে—এটি নিছক ‘ক্ষমতার কাঁচি।’

কিন্তু হায়, বৈচিত্র্য নামক জিনিসটা বারবার এই যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। কেউ জটা পাঁকিয়েছে, কেউ টাক হয়েছে, কেউ দাড়ি রেখেছে, কেউ শেভ করেছে। প্রকৃতি বলছে—সবাই এক নয়। কিন্তু আমাদের নাপিততান্ত্রিক সমাজ বলছে—সবাই এক হতে হবে, নইলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

এই ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে তর্ক-বিতর্ক শুরু হলো। একপক্ষ বলছে, সাধু-সন্ন্যাসীদের এভাবে হেনস্তা করা একেবারেই অমানবিক। অন্যপক্ষ বলছে, হাইজিন মেইনটেইন করা মানবিক কাজ। মানে, লোকের সম্মতি ছাড়াই তার চুল কেটে দেওয়া এখন মানবিকতার নতুন সংজ্ঞা। ভবিষ্যতে হয়তো রাস্তায় দাঁড়ানো সবাইকে জোর করে গোসল করানো হবে, আর সেটা ইউটিউবে আপলোড হবে ‘হিউম্যানিটি অ্যাওয়ার্ড’ জেতার আশায়।

এই দৃশ্য দেখে অনেক বিপ্লবীরও টনক নড়েছে। তারা হঠাৎ বুঝতে পারছেন—যে ইনকিলাবের জন্য তারা কলম ধরেছিলেন, সেই ইনকিলাবই এখন তাদের চুল-দাড়ি কেটে দিতে উদ্যত। যেই বিপ্লবী কাঁচি এতদিন ধরে সমাজকে সমান করার চেষ্টা করেছে, সেই কাঁচিই আজ তাদের মাথার ওপর ঘুরছে।

বাংলাদেশের সংবিধান বলে, প্রত্যেক নাগরিক মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার রাখেন। কারও প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাজারের মাঝখানে একজন বৃদ্ধকে ধরে বসিয়ে দাড়ি কেটে দেওয়ার চেয়ে অবমাননাকর দৃশ্য আর কী হতে পারে? অথচ আশ্চর্যজনকভাবে এখনো কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। উল্টো ভিডিও আপলোড করে প্রশংসা কুড়ানো হচ্ছে। তবে কি সত্যিই সরকারের আশীর্বাদ আছে এদের ওপর? যদি থাকে, তাহলে একে বলতেই হয়—’স্টেট স্পন্সরড নাপিততন্ত্র।’

হালিম উদ্দিন আকন্দ, যিনি ৩৪ বছর ধরে সন্ন্যাসী বেশে ছিলেন, তিনি ছিলেন স্বাভাবিক মানুষ। পরিবার ছিল, সমাজে পরিচিতি ছিল। তাকে বাজারের মাঝে বসিয়ে ট্রিমার চালানো হলো। পার্থক্য কোথায়? একজন ভিক্ষুকের দাড়ি কেটে দেওয়ার সঙ্গে তার দাড়ি কেটে দেওয়ার পার্থক্য কি আইন, কি নীতিতে টিকে?

গ্রামীণ হাটে আজও ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দররা ২০-৩০ টাকা নিয়ে চুল কাটেন। তারা খোলা আকাশের নিচে বসে অপেক্ষা করেন কাস্টমারের। অথচ নতুন প্রজন্মের নাপিতরা মোটরসাইকেলযোগে আসে, ক্যামেরা বয়ে আনে, তারপর বিনামূল্যে ‘মানবিক’ নামে ট্রিমিং সার্ভিস দিয়ে চলে যায়। পুরোনো নরসুন্দরদের চোখে পানি এসে যায়—তাদের শ্রমের বাজার একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, আজকাল নাপিত হওয়ার জন্য কেবল কাঁচি নয়, ইউটিউব চ্যানেলও লাগে।

প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়, সমাজও তাই। সবাইকে একরকম করার চেষ্টা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। নদী শুকিয়ে শহর বানালে বন্যা আসে, তেমনি চুল-দাড়ি কেটে সমাজকে এক করার চেষ্টা করলে একদিন সমাজই টিকবে না।

চুল-দাড়ি রাখা বা না রাখা নিছক ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু সেটাকে জোর করে কেটে ফেলা নিছক অপরাধ নয়, বরং সমাজের মাথা কেটে ফেলার সমান। হালিম উদ্দিনের মুখে শেষ পর্যন্ত যে শব্দ বের হয়েছিল—‘আল্লাহ তুই দেহিস’—সেটি শুধু তার কষ্ট নয়, বরং সমগ্র সমাজের এক আর্তনাদ।

আজ চুল-দাড়ি, কাল হয়তো পোশাক, আর পরশু হয়তো চিন্তাই কেটে দেওয়া হবে। যে সমাজ এভাবে সবাইকে এক ছাঁচে ফেলতে চায়, সে সমাজ আসলে নিজের মাথাটাই হারিয়ে ফেলছে।

হ্যাঁ, যে সমাজে মানুষকে জোর করে চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়, সে সমাজ শেষ পর্যন্ত বুঝতেই পারবে না—কে নাপিত, কে পাগল, আর কে আসল মানুষ।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম