শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড—শুধু একটি প্রচলিত প্রবাদ নয় বরং বাস্তবতা। সেই শিক্ষার মূল কারিগর হলেন শিক্ষক। ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ উপলক্ষে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষকতা পেশার চ্যালেঞ্জ, শিক্ষকের ভূমিকা এবং শিক্ষক দিবস পালনের তাৎপর্য নিয়ে উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক ও বিশ্লেষণ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য কী বলে মনে করেন? এর গুরুত্ব কতটা?ড. দেলোয়ার হোসেন: বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সূচনা হয়েছিল মূলত ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর। ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উদ্যোগে শিক্ষকদের মর্যাদা সংক্রান্ত একটি বিশেষ আন্তঃসরকারি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই ‘শিক্ষকদের মর্যাদা সংক্রান্ত ইউনেস্কো বা আইএলও সুপারিশমালা’ গৃহীত হয়েছিল। এই সুপারিশমালায় শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং পেশাগত মান নির্ধারণ করা হয়েছিল।
শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ দলিলটি গৃহীত হওয়ার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ইউনেস্কো ১৯৯৪ সালে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে শিক্ষকদের অসামান্য অবদান ও ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ এবং শিক্ষকতা পেশার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘শিক্ষকতাকে একটি যৌথ সহযোগিতার পেশা হিসেবে পুনর্নির্মাণ করা।’ বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে ১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—শিক্ষকদের অর্জন ও অবদানসমূহের পাশাপাশি শিক্ষা বিষয়ে তাদের যে পরিকল্পনা ও উদ্বেগসমূহ রয়েছে; সে সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি করা। বিশেষ করে বৈশ্বিকভাবে বিভিন্ন পক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করা। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ক্রমবিবর্তন প্রয়োজনসমূহ রয়েছে, তা চিহ্নিত করা। সেভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। যার মাধ্যমে শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন।
জাগো নিউজ: আপনার কর্মজীবনের গল্প শুনতে চাই, কেমন উপভোগ করছেন?ড. দেলোয়ার হোসেন: আমি প্রায় তিন দশক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সাথে যুক্ত রয়েছি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হই; সেখানেই শিক্ষকতা করছি। আমার শিক্ষকতা পেশা শুরু হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে। আমি প্রায় একই সময়ে শিক্ষকতা পেশা ও বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদানের সুযোগ পাই। পরিবারের সদস্য ও নানামুখী প্রভাব সত্ত্বেও শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নবীন প্রভাষক হিসেবে ১৯৯৫ সালে শিক্ষকতা পেশা শুরু হয়। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণ বা অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম ছিল না। অন্তত আমার নিজের ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ পাইনি। ফলে আমার শিক্ষকগণ, যারা আমার সহকর্মী ছিলেন; তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতায় নতুন পেশায় নিজেকে খাপ-খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে বিআইএসএস নামে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। বিভাগে কিছুদিন পরীক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের পর পূর্ব এশিয়া বিষয়াবলি শিরোনামের একটি স্নাতকোত্তর কোর্সের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের শুরু হয়। বাৎসরিক পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে তখন শিক্ষার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মাধ্যমে বর্তমান যে সেমিস্টার পদ্ধতি, তা চালু হয়। দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি। ২০০৯ সাল থেকে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা চলাকালীন দুই দফা উচ্চশিক্ষার ছুটি নিয়ে জাপানে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাথে একটি বিশেষ ও চমৎকার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, যা অন্য পেশায় সম্ভব নয়। ফলে শিক্ষকতা পেশাকে আমি উপভোগ করছি।
জাগো নিউজ: একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আপনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত রাখেন?ড. দেলোয়ার হোসেন: আমার শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থী হিসেবে আমার গুরুজন বা শিক্ষকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমার সব শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ার সময় সামাদ স্যার এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইয়াকুব আলী স্যারসহ অন্যান্যরা অনুপ্রাণিত করেছেন। উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের কাছ থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকরা আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার্থীরা কতটা অনুপ্রাণিত হচ্ছে, সেটা নিজের পক্ষে বলা অসম্ভব। তবে আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জীবনে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। প্রাচ্যের দর্শন ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের জীবনে শিক্ষকের প্রভাব অপরিসীম। নিজে একজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শিক্ষকগণ তাদের সত্যিকারের পেশাগত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, সময়মতো শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ, সঠিক সংখ্যায় ক্লাস নেওয়া, নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পারেন। নিঃসন্দেহে শ্রেণিকক্ষে পাণ্ডিত্য ও গবেষণা লব্ধ জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তবে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের আলোচনায় উদ্বুদ্ধ করা, স্নেহশীল আচরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আরও অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে।
জাগো নিউজ: আপনার মতে, একজন আদর্শ শিক্ষকের কী কী গুণ থাকা উচিত?ড. দেলোয়ার হোসেন: একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা। এই ভালোবাসা থেকে শিক্ষকের পেশাদারিত্ব, পরিশ্রম, আন্তরিকতা, প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা ও সহানুভূতিসহ বিভিন্ন গুণ উৎসারিত হয়। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একজন শিক্ষকের সাফল্য এনে দিতে পারে তা হচ্ছে দায়িত্বশীলতা। একজন দায়িত্ববান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পারেন। পেশাদারিত্ব থেকে শুরু করে সামাজিক মূল্যবোধ সবকিছুই একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক উপহার দিতে পারেন। তৃতীয়ত, ক্রমাগত জ্ঞান আহরণ এবং তা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ একজন শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য। গবেষণা ও নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে শিক্ষক তার জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। চতুর্থত, সৃষ্টিশীলতা বা সৃজনশীলতা একজন শিক্ষকের জন্য অত্যাবশ্যক। জ্ঞানের শাখায় নতুন নতুন চিন্তা, ধ্যানধারণা—শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। পঞ্চমত, একজন শিক্ষকের সর্বদা নৈতিকতার উঁচু মানদণ্ডে আসীন থাকতে হবে। আধুনিক ও জটিল সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন ও অবক্ষয়ের রাস্তা উন্মুক্ত। এ ধরনের পরিবেশে শিক্ষকগণের উঁচু নৈতিকতা সত্যিকার অর্থে সুন্দর ও কার্যকর করতে পারে। ষষ্ঠত, একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর আস্থা অর্জন করতে হবে। শ্রেণিকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে আচরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জন্য আস্থা ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিশেষে পরিবর্তনশীল সমাজ সম্পর্কে একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সাথে যুক্ত রাখবে। বর্তমান বিশ্বে এটি বিশেষভাবে আবশ্যক।
জাগো নিউজ: শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে বাংলাদেশে কী ধরনের পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন?ড. দেলোয়ার হোসেন: বাংলাদেশের বাৎসরিক বাজেটের আকার বিবেচনা করলে অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষাখাত বাজেট দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। জিডিপির শতাংশের হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যয় জিডিপির ১.৮ শতাংশ। যা ভারতের ক্ষেত্রে ৪.১ শতাংশ, নেপালের ৩.৭ শতাংশ, ভুটানের ৫.৮ শতাংশ, মালয়েশিয়া ৪.২৬ শতাংশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ বাংলাদেশে সব সময় বিদ্যমান। শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষতা অর্জনের জন্য গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি অত্যাবশক। কিছুদিন পূর্বে ইউজিসি একটি প্রতিবেদনের সূত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, কমপক্ষে ৫০টির অধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বরাদ্দ রাখা হয় না। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা বরাদ্দ অত্যন্ত কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের ৫৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সর্বমোট গবেষণা বাজেট ছিল ১,১৬৯ কোটি টাকা। যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ সালের গবেষণা বাজেট ২১.৫৭ কোটি টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট ৯ কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে শিক্ষাখাতে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রে স্কলারশিপ পেতে চান, রইলো ফয়সালের পরামর্শবিদেশে পড়তে যাওয়ার পর যেসব বিষয় জানা জরুরি
গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, সাধারণভাবে শিক্ষকরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থিংক ট্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। উন্নত ও নতুন বিত্তশালী দেশের সহযোগিতার ওপর দাঁড়িয়ে শিক্ষকগণ গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুঁজছেন। ফলে শিক্ষা ও গবেষণার বিষয়সমূহ বিদেশিদের দ্বারাই সব সময় নির্ধারিত হয়ে আসছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দিলে আর ফেরত আসছে না। যা ঐতিহাসিকভাবে ব্রেনড্রেন হিসেবে বিবেচিত।
তাই শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। প্রথমত, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সব স্তরের শিক্ষকদের সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। ৫৪ বছর পর বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য জাতীয় বেতন কাঠামোতে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে, যা বৈশ্বিক মানদণ্ড ও বাস্তবতার নিরিখে অনেক সীমিত। একই ধরনের সমস্যা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বিরাজমান। দ্বিতীয়ত শিক্ষা বাজেটে প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি প্রয়োজন। বিদেশি নির্ভরশীলতা হ্রাস করে নিজস্ব অর্থায়নে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি অপরিহার্য। তৃতীয়ত, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের স্বীকৃতি প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ে নামমাত্র বেতনে ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি সাম্প্রতিক সময়ে সম্ভবত বিলুপ্ত করা হয়েছে। চতুর্থত, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে নিজস্ব বাৎসরিক পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। এ পরিকল্পনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। পঞ্চমত, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ এবং জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি বিনির্মাণ প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা এ সংস্কৃতি সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারিনি। শিক্ষকদের গবেষণা বহুল অংশে তাদের পদোন্নতির শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক বাস্তবতা বিবেচনা করলে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষতা প্রায় ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। ষষ্ঠত, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও পুঁজিবাদের বিবর্তনের ফলে জ্ঞান সৃষ্টি এবং বিতরণের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির মধ্যে ত্রিমুখী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থে বৃহত্তর সমাজ তথা নীতিনির্ধারক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্তি বৃদ্ধি অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক ও যৌথ সহযোগিতা সম্পর্ক বৃদ্ধি করে দেশের সমৃদ্ধি করা সম্ভব।
জাগো নিউজ: আধুনিক বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান পিছিয়ে আছে কি?ড. দেলোয়ার হোসেন: শিক্ষার গুণগত বিকাশের ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বের তুলনায় সাধারণভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। সংখ্যার বিবেচনায় গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধি ও ধরে রাখার ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বে বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়। কিন্তু আমরা এখনো শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে পারিনি। প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য, যা যে কোনো দেশের জন্য অপরিহার্য। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ গুণগত ও পরিমাণগত ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় অনেক। সরকার যাবে, সরকার আসবে। কিন্তু দেশের শিক্ষানীতি অপরিবর্তিত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলেও তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। একটি এডহক ভিত্তিতে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, যা একেবারেই কাম্য নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাষ্ট্রের জাতিগঠনে অর্থবহ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি করছে। প্রথমত, পেশাগত দিক থেকে শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা অন্তত জরুরি। আধুনিক বিশ্বে শিক্ষকতা পেশাকে স্বতন্ত্র মর্যাদার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আর্থিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে সবার ঊর্ধ্বে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষকের মর্যাদা পেলে পেশাগত ভাবে শিক্ষকরা অবহেলিত।
গত ৫০ বছর সময়ে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সব খাতে পেশাগত উৎকর্ষতা, প্রণোদনা কাঠামো ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষাখাতে তেমন দেখা যায়নি। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে সাধারণভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাঁচার অর্থনৈতিক যুগে শিক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী ও গতিশীল হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লব্ধ জ্ঞানকে রাষ্ট্রের পরিচালনা ও অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্তি করতে হবে। রাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়ন ও বেসরকারি খাতের উন্নয়নের জন্য শিক্ষক ও গবেষকদের সহায়তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া প্রয়োজন। তৃতীয়ত, সব পর্যায়ের শিক্ষকের দায়িত্বশীলতা ও পেশাগত কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির জন্য কার্যত জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। পরিশেষে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিদেশ নির্ভরতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে হবে। শিক্ষাসংক্রান্ত নীতি বাস্তবায়নে দেশীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরি। গবেষণার উদ্দেশ্য ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজস্ব বিবেচনা প্রতিষ্ঠা অনস্বীকার্য।
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সমাজ গঠনে একজন শিক্ষকের কী ভূমিকা থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?ড. দেলোয়ার হোসেন: প্রায় প্রতিটি সফল রাষ্ট্রের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সমাজ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অবধারিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা ও বিতরণের বাইরে একজন শিক্ষক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রাখেন। সম্পূর্ণ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন ও পরামর্শ দান কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারে। আমি মনে করি, প্রয়োগ ও স্বীকৃতিবিহীন জ্ঞান সমাজের বিকাশে অর্থবহ ভূমিকা পালন করে না। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের উৎকর্ষতা যেমন শিক্ষকের দায়িত্ব; তেমনই বৃহত্তর সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনে শিক্ষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভূমিকা রাখতে পারে। অগ্রসর সমাজে দেখা যায়, শিক্ষকরা রাষ্ট্রের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন আবার রাষ্ট্রের কর্মকর্তা কিংবা নীতিনির্ধারকগণ শিক্ষকতা পেশায় অবদান রাখেন। এ ক্ষেত্রে একটি আস্থাপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক জরুরি। প্রাচীনকাল থেকে দেখা যায়, এ অঞ্চলে শিক্ষকগণ সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিকাশে অগগ্রামী ভূমিকা পালন করে আসছেন। মানুষের আস্থা ও নির্ভরতার জায়গায় শিক্ষকরা অবস্থান করে আসছেন। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও সমাজের স্বার্থে অতীতের আস্থা ও নির্ভরতা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
জাগো নিউজ: একজন শিক্ষক হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?ড. দেলোয়ার হোসেন: শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত করার পাশাপাশি গবেষণার কাজে নিজেকে আরও যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। অত্যন্ত গতিশীল ও বিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে ক্রমাগত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষক ও গবেষক কর্তৃক গ্রন্থ প্রকাশের সংখ্যা খুব কম। এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা। পররাষ্ট্র নীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে দুটি গ্রন্থ প্রকাশ নিয়ে কাজ করছি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের প্রভাব ও বাংলাদেশে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি বিষয়ে গ্রন্থপ্রকাশের আশা রাখছি। সর্বোপরি একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার সামর্থ বৃদ্ধির ব্যক্তিগত-প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ বৃদ্ধির জন্য নিরন্তর কাজ করে যেতে চাই।
এসইউ/জেআইএম