আইন-আদালত

শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, আমার মনটা শাহবাগে পড়ে থাকে

শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি ইঙ্গিত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, ‘আমার মনটা শাহবাগে পড়ে থাকে।’ শাহবাগ ছিল সরকারের তৈরি করা মব।’

রোববার (১২ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় শুনানিতে তিনি এসব কথা বলেন।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় পুলিশ গুমের মামলা নিতে চাইতো না। হাইকোর্ট বলতো, গুমের অভিযোগ পুলিশ তো স্বীকার করছে না। শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড ছিল বিরোধীদের রাজনৈতিক আওয়াজ বন্ধ করার প্রক্রিয়া।

‘মিরপুরে একজনকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করা হয়, তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল। চুলে আগুন লেগে যায়। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হা হা করে হাসছিল। আমরা তদন্তের সময় এ বিষয়ে একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, মাথায় কেন গুলি করা হয়? তারা উত্তর দেয়, ‘মাথায় গুলি না করলে মরতে দেরি হয়।’ এখান থেকেই জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্রদের পাখির মত গুলি করার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। মাই লর্ড, আমরা বোঝাতে চাই যে, এ ঘটনা হঠাৎ করে হয়নি, এটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্র্যাকটিস’- শুনানিতে বলেন তাজুল ইসলাম।

১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। এ আইনটি সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত, আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর।

তিনি বলেন, এ আইনের অধীনে এর আগে পৃথক দুটি ট্রাইব্যুনালে ৫৬টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ও ১৫ বছরের গুম-খুন, নির্বাচনে অনিয়ম ও ক্রসফায়ারের তথ্য তুলে ধরেছেন তিনি। প্রথমদিন রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার পর আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।

এদিন ট্রাইব্যুনাল–১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলে এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়েছে। প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন, বিগত সরকার কিভাবে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছিল, কিভাবে দেশকে গুম-খুনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল, কিভাবে অপরাধচক্র গড়ে তুলেছিল, সেসব বিষয় আদালতের নজরে তুলে এনেছি। বিগত সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করেছিল, ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল, এসবও তুলে ধরেছি।

যুক্তিতর্কে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার সরকারের দুঃশাসনের ফিরিস্তি তুলে ধরেন তাজুল ইসলাম। পাশাপাশি ১/১১ এর সেনা শাসনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, দাবি আদায়ের নামে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সেনা সমর্থিত শাসন এনেছে। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়ার আগেও সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেও না পেরে তিনি দেশত্যাগ করেছেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ মুজিবের আমলে রক্ষীবাহিনী দিয়ে নাগরিকদের রাতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। এ কাজটি শেখ হাসিনার আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করেছে আয়নাঘর বানিয়ে। এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টারি আমরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছি।

এসময় আদালত চিফ প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চান, আলোচ্য মামলায় এ ঘটনা দিয়ে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন।

জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, এটা আওয়ামী লীগের অপরাধী মনের পরিচায়ক। এটা সামনে না থাকলে তাদের শাসনামলের নমুনা জাতি বুঝতে পারবে না। তাই এ পটভূমি বিচারের সময় বিবেচনায় নিতে হবে।

বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাধা ছিল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাই পিলখানা হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। এটি ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, যেন ইচ্ছামত নির্বাচন করা যায়। দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয় জুডিসিয়াল কিলিং, এর মাধ্যমে আইন পরিবর্তন করে ফাঁসি দেওয়া হয়।

‘শেখ হাসিনাকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘আপনি (একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের) বিচার করেন। হাসিনা জবাব দেন, ‘বিচার করার জন্য প্রমাণ কোথায় খুঁজে পাবো।’ প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, ‘প্রমাণের ব্যবস্থা আমি করবো’- যোগ করেন তিনি।

এসময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি বলেন, বিচারকরা যা খুশি তা করবে, এর একটা নিয়ন্ত্রণ বা জবাবদিহি থাকা দরকার। আমি মনে করি, এর জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল থাকা দরকার।

তাজুল ইসরাম বলেন, এ ধরনের একটা কাউন্সিল আছে, যেটা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল।

এফএইচ/এমকেআর/জিকেএস