মতামত

পাহাড়ের কান্নায় বোধ জাগবে না?

‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই। ওই পাহাড়ের ঝরনা আমি, ঘরে নাহি রই গো উধাও হয়ে বই।’ কাজী নজরুল ইসলাম এই গানে পাহাড় আর আকাশের অসাধারণ মিতালীর কথা বলেছেন নান্দনিক উপমায়। বাস্তবে আকাশে হেলান দিয়ে না ঘুমালেও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু মানুষ এখন এমনই অকৃতজ্ঞ ও অবিমৃশ্যকারী হয়ে উঠছে যে তারা প্রকৃতির ওপর নির্বিচার অত্যাচার চালাচ্ছে। আর মানুষের নির্বিচার অত্যাচারের কারণে প্রকৃতিও হয়ে উঠেছে বৈরী। ফলে প্রকৃতির মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রতিশোধপরায়ণতা।

একে প্রতিশোধপরায়ণতাই বা বলি কী করে! পাহাড়ের ওপর থেকে গাছ কেটে, ট্রাকে ট্রাকে মাটি কেটে পাহাড়কে ন্যাড়া করে ফেললে বৃষ্টিবাদলায় তার ধসে পড়া ছাড়া আর কি কোনো উপায় থাকে? আর পাহাড়ের ঢালুর নিচে যেসব অসহায় মানুষ বসতি স্থাপন করে তাদের মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়। প্রতি বছরই পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে। তবে পাহাড়ধসের শঙ্কা এখন আর বর্ষাকেন্দ্রিক নয়। সারা বছর ধরেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। পর্যটন নগরী কক্সবাজারেও ঘটছে পাহাড়ধসের ঘটনা।

জাগো নিউজের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি সায়ীদ আলমগীর এর ‘মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ প্রশাসন, পাহাড়ধসে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল’ শিরোনামের খবরটি আমাদের উদ্বেগাকুল করছে। বর্ষা মৌসুম চলে গেলেও ভারী বৃষ্টি হলেই সেখানে ঘটছে পাহাড়ধসের ঘটনা। এতে প্রাণহানিও হচ্ছে।

লাখ লাখ বছরের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই পাহাড়গুলোর বেঁচে থাকাটাও সমান জরুরি। কিন্তু মানুষ তার হিংস্র থাবা বসিয়েছে পাহাড়ের ওপর। বাংলাদেশ এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। তার ওপর পাহাড় কাটার কারণে ভূমিকম্প ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় পাহাড় কাটা, পাহাড় দখল, সেখানে বসতি গড়া বন্ধ না হলে পাহাড়ের কান্নাও বন্ধ হবে না।

গত এক দশকে (২০১৫-২০২৫) ২১টি পাহাড়ধসের ঘটনায় কক্সবাজার জেলায় মারা গেছে ৪৮ জন। এদের মাঝে ২৯ জন স্থানীয় আর ১৯ জন আশ্রিত রোহিঙ্গা। ২১টি পাহাড়ধসের ঘটনায় ১০টিই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের। এসব পাহাড়ধসে ২৫-৩০ জন আহতও হয়েছিলেন বলে প্রশাসনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২৫টির বেশি পাহাড়ধসের ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পরও পাহাড় কাটা বা পাহাড়ে বাস থামেনি। উল্টো ৫০-৭০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া এবং পাদদেশে ঘরবাড়ি তৈরি হয় দেদারসে। পাহাড় কাটার মাটি বৃষ্টির সঙ্গে পৌরসভার ড্রেনে গিয়ে পড়ায় সামান্য বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।

যুগ যুগ ধরে কক্সবাজার শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে কয়েক লাখ মানুষ। এর মাঝে কক্সবাজার শহরেই ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার। তবে অনেকেই বলছে স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা শুধু মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ থাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকানো যাচ্ছে না। আবার বনবিভাগ বা পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালালেও পাহাড় কাটা না থামায় মৃত্যুর মিছিল থামছে না।

শুধু কক্সবাজারেই নয় সারাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলেই ঘটছে ধসের ঘটনা। স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। এতে প্রায় ১২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তখন টনক নড়েছিল চট্টগ্রাম প্রশাসনের। এ ঘটনার পর সরকার হাতে নিয়েছিল বেশ কিছু পরিকল্পনা। কিন্তু পরে তার কোনোটির বাস্তবায়ন আর হয়ে ওঠেনি। এরপরও নিয়মিতভাবে পাহাড়ধসে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলছে।

পাহাড়ধসের ঘটনা বারবার কেন ঘটছে? তা তদন্ত করলে বের হয়ে আসে সুবিধভোগী রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিবাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম নগরীতে একশ্রেণির রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী পাহাড় কেটে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করার কারণে অল্প বৃষ্টিতে পাহাড়ের পাদদেশ বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ ভূমি দখল নিয়ে আধা-পাকা ঘর নির্মাণ করে ভূমিহীনদের কাছে কম দামে ভাড়া দেয়। এভাবে গত ২০ বছরে চট্টগ্রামে ১১০টি পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও আশ্চর্যজনক হচ্ছে এই পাহাড়েরও মালিক আছে! এই তথাকথিত মালিকরাই পাহাড় কেটে মাটি লুট করে। পাহাড়ের ঢালু জায়গায় অসহায় মানুষদের থাকতে বাধ্য করে। তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় হয়। এতে রয়েছে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য। সরকার যাবে, সরকার আসবে। কিন্তু পাহাড় দখলকারীদের গায়ে ফুলের টোকা পড়বে না। কারণ যারা দখলদারি চালায় তারা জানে ভাগবাটোয়ারা কোন পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। তাই খোদ সরকারের নির্দেশও কার্যকর হয় না।

চট্টগ্রামের ১২টি পাহাড়কে ভূমিধসের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সরকারিভাবে গঠিত তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও কক্সবাজার পৌরসভার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেই সুপারিশ কার্যকর হয়নি আজও। শুধু তা-ই নয়, পাহাড় না কাটার কোনো নির্দেশও বাস্তবায়িত হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) ও (সংশোধিত) ২০১০-এর ৪ নম্বর ধারার ৬-খ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইবে না।’ শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয় আইনে পাহাড় কাটার জন্য দুই বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু পাহাড় কাটা বা ধসের কারণে শত শত মানুষের জীবন গেলেও এজন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো নজির নেই।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দিপু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে, ভরাট হচ্ছে সাগরের তলদেশ। সেখানে পাহাড়ের মাটি উপকূল ভরাট আরও ত্বরান্বিত করছে। অভিযোগ উঠছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিহ্নিত কিছু দুর্নীতিবাজ পাহাড় খেকোদের নানা ভাবে সহযোগিতা দেয়। এ কারণে পাহাড় কাটা বন্ধ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে প্রশাসনের আরও কঠোরতা দরকার।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিয়ে শুষ্ক মৌসুমে তেমন ভাবা হয় না। কিন্তু ভারী বর্ষণে পাহাড়ধসের শঙ্কা তৈরি হলে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকাতে ঝুঁকিতে থাকাদের নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। প্রয়োজনে যৌথ অভিযানও চালানো যায়। সব বিষয়ে প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। প্রশাসন সতর্ক রয়েছে-এটা যেন কেবল মুখের কথা না হয়। আমরা কাজেও এর প্রমাণ দেখতে চাই।

গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে পাহাড়ধস মোকাবিলায় ‘ন্যাশনাল আর্লি অ্যাকশন প্রটোকল ফর ল্যান্ডস্লাইড’ শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কর্মশালায় বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাহাড়ধস ব্যবস্থাপনায় একটি জাতীয় প্রটোকলের খসড়া তৈরি, বর্তমান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ঘাটতি চিহ্নিত করা এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আবদুল ওয়াদুদ বলেন, পাহাড়ধস মোকাবিলায় এ কর্মশালা মাঠপর্যায়ে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। পাশাপাশি এ কর্মশালা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিল সংক্রান্ত আলোচনাকে আরও দৃঢ় করবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, কর্মপরিকল্পনাগুলো কেবল জাতীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। বিশেষত ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করে তা জাতীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

কর্মশালার মূল লক্ষ্য ছিল জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় পাহাড়ধস মোকাবিলায় আগাম কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়ে একটি বিস্তৃত জাতীয় কার্যবিধির খসড়া তৈরি করা। একটি ‘জীবন্ত নথি’ হিসেবে এই কার্যবিধি তৈরি করা হবে। এটি নিরন্তর আপডেট ও উন্নত করা যাবে। (সূত্র: প্রথম আলো) পাহাড় রক্ষায় এ ধরনের কর্মশালা ও আলোচনা চালু রাখা অত্যন্ত জরুরি।

মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের কথায় সুবীর নন্দী গেয়েছেন ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বলো/ ঐ পাহাড়টা বোবা বলেই কিছু বলে না, তোমরা কেন বোঝ না যে কারও বুকের দুঃখ নিয়ে কাব্য চলে না। মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায় পাহাড় আসলে কাঁদে। পাহাড় প্রকৃতির এক অপার দান।

লাখ লাখ বছরের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই পাহাড়গুলোর বেঁচে থাকাটাও সমান জরুরি। কিন্তু মানুষ তার হিংস্র থাবা বসিয়েছে পাহাড়ের ওপর। বাংলাদেশ এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। তার ওপর পাহাড় কাটার কারণে ভূমিকম্প ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থায় পাহাড় কাটা, পাহাড় দখল, সেখানে বসতি গড়া বন্ধ না হলে পাহাড়ের কান্নাও বন্ধ হবে না।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর জাগো নিউজ। drharun.press@gmail.com

এইচআর/এমএফএ/জিকেএস