জাতীয়

ধোঁয়ায় ঢাকা রূপনগর, নিরাপত্তাহীন শহরের প্রতিচ্ছবি

মিরপুরের রূপনগর এলাকায় সকালটা শুরু হয়েছিল সাধারণ দিনের মতোই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যায় পুরো আকাশ। রূপনগরের কেমিক্যাল গোডাউন থেকে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে চারদিকে। মুহূর্তেই বাতাস ভারি হয়ে ওঠে, ছড়িয়ে পড়ে তীব্র রাসায়নিক গন্ধ। আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় ফায়ার সার্ভিসের একের পর এক ইউনিট। তবে এই আগুন অন্যসব আগুনের মতো নয়। কারণ এখানে জ্বলছে কেমিক্যাল-যার ধোঁয়ায় লুকিয়ে আছে ভয়ানক বিষ। তাই আগুন নিয়ন্ত্রণে নামার আগে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের পড়তে হয় বিশেষ কেমিক্যাল ফায়ার স্যুট। সেই স্যুট পরে, ঝুঁকির মাঝেই চারজন ফায়ার ফাইটার সাহসের সঙ্গে ঢুকে পড়েন আগুনের উৎসস্থলে। চারদিক ধোঁয়ায় অন্ধকার, বাতাসে শ্বাস নেওয়াই কঠিন-তবু তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আগুন নেভানোর।

কেমিক্যাল পোড়ার গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ায় ঘটনাস্থলে থাকা সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরে থাকতে হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা বারবার অনুরোধ করছেন, ‘দয়া করে দূরে থাকুন, বাতাসে বিষাক্ত রাসায়নিক আছে।’

তবুও রাস্তার পাশে ভিড় জমাচ্ছেন উৎসুক মানুষ। কেউ মোবাইল হাতে ভিডিও তুলছেন, কেউ লাইভ দিচ্ছেন, কেউ আবার কৌতূহল মেটাতে ধোঁয়ার ভেতর তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন।

কেমিক্যালের আগুন কতটা বিপজ্জনক, সেটা অনেকেই বোঝেন না। এই আগুনে শুধু আগুনের তাপ নয়, ধোঁয়ার প্রতিটি কণায় থাকে ক্ষতিকর গ্যাস-যা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ঢুকে দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

আগুন নেভানোর কাজটা ছিল একেবারে সময়ের সঙ্গে যুদ্ধের মতো। কেমিক্যাল আগুনের ক্ষেত্রে সাধারণ পানি ব্যবহার করা যায় না; এতে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই ফায়ার সার্ভিসকে ব্যবহার করতে হয় বিশেষ ফোম ও রাসায়নিক পদার্থ। প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হয় সাবধানতার সঙ্গে, কারণ সামান্য ভুলও হতে পারে প্রাণঘাতী।

১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাককারখানা ও কসমিক ফার্মা নামের এক কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন। সবার মরদেহ পোশাককারখানার ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ওই ভবনের নিচতলায় আগুনের তীব্রতা থাকায় এবং ছাদে ওঠার দরজা দুটি তালা দিয়ে বন্ধ থাকায় অনেকেই ভবন থেকে বের হতে পারেননি। ফলে ওই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আটকে আগুনে পুড়ে নিহত হয়েছেন তারা। সেদিন রাতে অগ্নিনিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব তথ্য জানান।

আগুন লাগার পর মুহূর্তেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। অনেক বাসিন্দা ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ান। কেউ জানে না আগুন ছড়িয়ে পড়বে কিনা, কেউ চিন্তায় আছে বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে।

রূপনগরের এই আগুন আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল-শহরের ভেতরে কেমিক্যাল গোডাউন কত বড় বিপদ হয়ে আছে। অগণিত এমন গোডাউন রয়েছে মিরপুর, চকবাজার, নারায়ণগঞ্জ বা পুরান ঢাকায়-যেগুলোর অধিকাংশই আবাসিক ভবনের নিচে বা গলির ভেতরে। কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই, নেই যথাযথ অনুমতিও।

প্রতিবার আগুন লাগার পরই তদন্ত, আশ্বাস আর পরের দিনের নীরবতা-এই চক্র কখনোই ভাঙে না। অথচ প্রতিটি গোডাউন যেন একটি ‘টাইম বোমা’, যা যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টার পর অবশেষে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু বাতাসে এখনো ভাসছে পোড়া কেমিক্যালের গন্ধ। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ক্লান্ত, কিন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারেননি পুরোপুরি। কারণ তারা জানেন-আগুন নিভেছে, কিন্তু এর কারণ, এর পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত নয়। রূপনগরের এই আগুন আবারও মনে করিয়ে দিল-কেমিক্যালের আগুন নিভে যায়, কিন্তু অবহেলার আগুন কখনোই নিভে না।

জেএস