আন্তর্জাতিক

ভারত-পাকিস্তান-নেপালের চেয়ে বাংলাদেশে সোনার দাম বেশি কেন?

সোনার দাম সব দেশেই বাড়ছে। তবে পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের তুলনায় দাম বেশি বেড়েছে বাংলাদেশে। দুই বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে এই ধাতুর মূল্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে সোনার বাজারে অস্থিরতার কারণ কী? এর দাম কি কমতে পারে, নাকি আরো বাড়বে? অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে সোনার দামে তফাৎ কতটা?

এমন নানা বিষয় ঘুরেফিরে আসছে মানুষের মনে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে সোনার দাম প্রথমবারের মতো প্রতি ট্রয় আউন্স (৩১.১০ গ্রাম) চার হাজার দুইশ ডলারে পৌঁছায়। মাত্র তিন বছর আগে, অর্থাৎ ২০২২ সালের শুরুতে যা ছিল দুই হাজার ডলারের নিচে। ২০২৩ এরপর থেকে মূল্যবান এই ধাতুর দাম কেবলই উর্ধ্বমুখী হয়েছে।

বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সোনার দাম বেড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বাজুস এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো ২২ ক্যারেট সোনার দাম লাখের ঘরে পৌঁছায়।

দুই বছরের ব্যবধানে ২০২৫ এর অক্টোবরে হয়েছে দুই লাখের বেশি, যা বর্তমানে ভরি প্রতি দুই লাখ ১৬ হাজার ৩৩৩ টাকা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সোনার দাম নিবিড়ভাবে যুক্ত। অর্থাৎ যুদ্ধ কিংবা অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হলে এর দামে এক ধরনের প্রভাব পড়ে। আর এ কারণেই করোনার পর, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলমান থাকায় সোনার দাম আর কমেনি।

তবে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সোনার দাম বৃদ্ধির পেছনে সরকারের নীতির দুর্বলতা, ডলারের বিপরীতে টাকার মানের পতন এবং ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার প্রবণতাকেও দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে দাম বেড়েছে বলেই যে ঢালাওভাবে এর চাহিদা কমেছে বিষয়টি এমনও নয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আপদকালীন সম্পদ হওয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যক্তিখাতের বড় বিনিয়োগকারিরা সোনা ক্রয় এবং সংরক্ষণ বাড়িয়ে দেন যা বিশ্বে এই ধাতুর চাহিদা ও প্রাপ্যতার মধ্যে অসামঞ্জস্য পরিস্থিতি তৈরি করে।

তবে এক্ষেত্রে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের সোনা কেনার সুযোগ বা প্রবণতা অনেক কমে আসছে বলেও মনে করেন তারা।

সোনার দাম কেন বাড়ছে?চাহিদা বেশি হলেও সোনার উৎপাদন অসীম নয়। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বে চার হাজার ৯৪৬ টন সোনা সরবরাহ করা হয়, গত বছর যা বেড়ে চার হাজার ৯৭৫ টন হয়েছে।

তবে এই সময়ে বৈশ্বিক নানা কারণে সোনায় ব্যপকভাবে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যক্তিখাতের বড় বিনিয়োগকারীরা।

২০২২ সালের শেষ দিক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে প্রতি বছর এক হাজার টনেরও বেশি সোনা কিনেছে যা ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গড়ে ৪৮১ টন ছিল। গত বছর শীর্ষস্থানীয় ক্রেতাদের মধ্যে ছিল পোল্যান্ড, তুরস্ক, ভারত, আজারবাইজান ও চীন।

মূলত গ্রহণযোগ্য বা বাস্তব সম্পদ হওয়ায় যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দাসহ বৈশ্বিক নানা পরিস্থিতি সোনার বাজারকে সরাসরি প্রভাবিত করে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, করোনা মহামারির পর থেকে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে সোনা। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেনসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণেও অন্য খাতের তুলনায় সোনায় বিনিয়োগ বেড়েছে।

এর আগেও ২০০৮-০৯ সালে সোনার দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা, আরব বিশ্বের রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে ২০১১ সালে সোনার দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে আউন্স প্রতি এক হাজার ৯১৭ ডলার হয়েছিল, বাংলাদেশে যা ছিল ৪৮ হাজার টাকা প্রতি ভরি।

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন দেশে সম্পূরক শুল্ক আরোপের পর থেকে বিশ্বব্যাপী যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে তার ফলে পরিস্থিতি আরও বিরূপ হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের শক্তি কমাও একটি বড় কারণ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ হিসেবে ডলার সংরক্ষণে এতদিন অনেক বেশি গুরুত্ব দিলেও বর্তমানে একক মুদ্রার ওপর নির্ভর করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় রিজার্ভ হিসেবে সোনার সংরক্ষণ বাড়িয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, গ্লোবাল ইকোনমিতে যে ভোলাটিলিটি (অস্থিরতা) দেখা যাচ্ছে তাতে অনেক দেশ বা ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগকারী ডলার না রেখে ট্যানজিবল অ্যাসেট (ধরা-ছোঁয়া যায় এমন সম্পদ) রাখতে চাচ্ছে বলেই গোল্ডের ওপর চাপ বাড়ছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের দামে পার্থক্যবিশ্বের প্রতিটি দেশে সোনার দাম ভিন্ন হয়, কারণ দাম নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট দেশের শুল্ক একটি বড় ভূমিকা পালন করে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং আমদানি ব্যয়ে সামঞ্জস্য রাখতে অনেক দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সোনা আমদানিকে উৎসাহিত করে না। তবে আপদকালীন সম্পদ হিসেবে সোনা ঠিকই রিজার্ভ করে দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বৈধ পথে সোনা আমদানিতে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশে ২০১৮ সালে নীতিমালা করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছিল সরকার। কিন্তু তাতে তেমন সাড়া মেলেনি।

তবে ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী, বিদেশ থেকে একজন যাত্রী বছরে মোট ১০০ গ্রাম ওজনের সোনার গয়না বিনা শুল্কে আনতে পারেন। এছাড়া বছরে একবার ১১৭ গ্রাম ওজনের একটি মাত্র সোনার বার আনতে পারবেন একজন যাত্রী। তবে এক্ষেত্রে প্রতি ভরিতে (১ ভরি = ১১.৬৬ গ্রাম) পাঁচ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনার রিজার্ভের পরিমাণ এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে সেই দেশের মুদ্রা কতটা শক্তিশালী তাও সোনার দামকে প্রভাবিত করে।

ব্যবসায়িক ওয়েবসাইট ফোর্বসের মতে, বাহরাইন, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, দুবাই, আমেরিকা এবং পেরুতে অন্যান্য দেশের তুলনায় সোনা সস্তায় পাওয়া যায়।

তবে বাংলাদেশে সোনার দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি বলেই অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর চেয়েও এই সংখ্যা অতিরিক্ত। যদিও এটি সঠিক নয় বলে দাবি এই খাতের ব্যবসায়ীদের।

ওয়ার্ল গোল্ড কাউন্সিলের (সোনার বাজার মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান যার সদস্য ৩১টি সোনা খননকারী কোম্পানি) ওয়েবসাইটে ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব বাজারে প্রতি গ্রাম (১১.৬৬ গ্রাম = ১ ভরি) সোনার মূল্য ১৩৪.৯৬ মার্কিন ডলার বা ১৬ হাজার ৪২৫ টাকা।

একই সময়ে ভারতে ২২ ক্যারেট সোনা প্রতি গ্রামের দাম ১৩৪.৭০ মার্কিন ডলার, পাকিস্তানে ১৩৬.৯৪ মার্কিন ডলার, নেপালে ১২৫.০৫ মার্কিন ডলার, মালয়েশিয়ায় ১৩১.১৪ মার্কিন ডলার, সৌদি আরবে ১২৬.৯১ ডলার এবং কাতারে ১২৭.৯৭ ডলার।

এসব দেশের বিপরীতে বাংলাদেশে সোনার দাম অনেকটাই বেশি। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বাজুসের দেওয়া সবশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ২২ ক্যারেটের প্রতি গ্রাম সোনার দাম ১৫২.৩৯ ডলার বা ১৮ হাজার ৫৪৭ টাকা।

যদিও এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির সুযোগ না থাকায় অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে সোনা ক্রয়, ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমনসহ নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করেই সোনার দাম নির্ধারণ করা হয়।

বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকার যদি সোনা আমদানি করতো বা সেন্ট্রাল ব্যাংক যদি আমাদেরকে গোল্ড দিত তাহলে সোনার বাজার আরও নিয়ন্ত্রিত থাকতো। আমাদের দেশ চলে রিসাইকেল গোল্ডের ওপর, এ কারণেই হয়তো একটু ঊনিশ-বিশ হতে পারে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে লাগেজের আওতায় এক ভরি সোনা আনলে সরকারকে যে শুল্ক দিতে হয়, বৈধ পথে সোনা আমদানি করলে তার তুলনায় অনেক বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেও দায়ী করছেন তারা।

সোনার দাম কি কমতে পারে?বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বর্ণে বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ এমন আলোচনা থেকেই সামনে আসছে দাম কমার প্রশ্নটি। সোনার বাজারে ধারাবাহিক অস্থিরতার কারণে এ বিষয়ে সঠিক পর্যালোচনা দেওয়া বেশ কঠিন বলেই দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতি ও যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ের ওপর সোনার বাজার নির্ভর করে। তাই বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে মন্তব্য করা বেশ কঠিন।

তবে অতীত অভিজ্ঞতা এবং বাজার প্রবণতা বিবেচনায় এর দাম আগামী কয়েক বছরে কমার সম্ভাবনা নেই বরং আরও বাড়তে পারে বলেই মনে করেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।

বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত, ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবনমনসহ নানা কারণে সোনার দাম সহসা কমছে না।

তিনি বলেন, জিও পলিটিকাল টেনশন যদি না কমে , যুদ্ধ চলমান থাকে, আমেরিকার ট্যারিফ যুদ্ধ বন্ধ না হয় তবে ইমিডিয়েট গোল্ডের দামও কমে যাবে এর সুযোগ নাই।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস এক পূর্বাভাসে বলেছে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রতি আউন্স সোনার দাম চার হাজার ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। যা বর্তমানে চার হাজার ২০০ ডলারের আশপাশে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলছেন, সোনার দামের সঙ্গে অনিশ্চয়তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকিং সুদের হারের ওপরও এটি নির্ভর করে।

তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক স্বচ্ছতা ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তাদের অবস্থানের কারণে আগে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভের ক্ষেত্রে ডলারকে অনেক প্রাধান্য দিত, সবাই ডলারকেই নিরাপদ জায়গা হিসেবে মনে করতো। কিন্তু ইদানিং বিভিন্ন পপুলার কারেন্সির বাইরে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে গোল্ডের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।

সোনার দাম আরও বাড়তে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা বলা কঠিন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত এবং ডলারের সুদের হারের ওপর এগুলো অনেকটা নির্ভর করে।

বাংলাদেশে সোনার বাড়তি দাম প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যেসব দেশে সোনা উৎপাদন হয় এবং সরকারিভাবে আমদানির সুযোগ রয়েছে সেসব দেশের সঙ্গে মিল থাকবে না এটা স্বাভাবিক।

তবে বাজারের ওপর কেবল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলো। এক্ষেত্রে সোনা চোরাচালানের সুযোগও তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

টিটিএন