দেশজুড়ে

নির্মল বায়ুর শহর রাজশাহী এখন দূষণের নগরী

অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত নির্মাণ কর্মকাণ্ড, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও জলাশয় ভরাট, বর্জ্য অব্যবস্থাপনা এবং ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে রাজশাহী শহরে বসবাসরত প্রায় দশ লাখ মানুষ। এক সময়ের বাংলাদেশের ‘সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ নগরী’ হিসেবে পরিচিত রাজশাহী এখন অন্যতম দূষণের নগরী। ২০১৬ সালে নির্মল বায়ুর জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া এই শহরটি সাম্প্রতিক সময়ে বায়ু দূষণে রাজধানী শহর ঢাকাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা বায়ুর গুণমান সূচক (একিউআই) ৫০ এর সীমা পর্যন্ত সাধারণত নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়। তবে একিউআই এর মান ১০০ অতিক্রম করলে, বায়ু ক্রমশ ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে থাকে। একিউআই এর মান ২০০ অতিক্রম হলে সেই বায়ুকে অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০০ এর ওপরে হলে বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়। এমতাবস্থায় জনসাধারণকে ঘরের বাইরে অবস্থানকালে মাস্ক পরিধান করা এবং সংবেদনশীল ব্যক্তিদের জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত ঘরের বাইরে অবস্থান না করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। এর প্রধান কারণগুলো হলো স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জিরো কার্বন এনালাইটিক্স-এর সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে গত ২০২১ সালে বাংলাদেশে ১৯ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করেছে।

আরও পড়ুন-বায়ুদূষণে শিশুমৃত্যু এখন বাংলাদেশের নীরব মহামারিরাত বাড়লেই ভাগাড়ে রূপ নেয় মাগুরা শহরলাহোর-দিল্লির চেয়ে ঢাকার বায়ুর মানের উন্নতি

পরিবেশ অধিদপ্তর এবং আন্তর্জাতিক বায়ু পর্যবেক্ষকদের সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজশাহী শহরের বায়ুর মান নিয়মিতভাবে ২০০ এর সীমা অতিক্রান্ত করছে। এমনকি কোনো কোনো সময় বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে তা ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে।

পর্যালোচনা অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৪ সালে রাজশাহী নগরীর একিউআই এর মান ৩০০ এর সীমা ছাড়িয়েছিল তিন দিন। তখন সর্বোচ্চ একিউআই এর মান রেকর্ড করা হয়েছিল ৩১৭ এবং ২০০ এর ওপর ছিল ৪৮ দিন।

তবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই নগরীর একিউআই এর মান ৩০০ এর সীমা ছাড়িয়েছে সাত দিন। আর জানুয়ারিতে রাজশাহী শহরের একিউআই এর মান টানা তিন দিন ৩০০ এর সীমা ছাড়িয়েছে। আর ২০০ ছাড়িয়েছে ১৮ দিন। এসময় সর্বোচ্চ একিউআই এর মান রেকর্ড করা হয়েছিল ৩৯৪।

তুলনামূলকভাবে, জানুয়ারি মাসে ঢাকায় একিউআই এর মান ৩০০ এর ওপর রেকর্ড করা হয়েছিল মাত্র একদিন যা সর্বোচ্চ ৩৬৭ এর সীমায় পৌঁছেছিল এবং ২৪ দিন ২০০ এর ওপর ছিল।

একইভাবে ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহীতে একিউআই এর মান তিন দিন ৩০০ এর ওপর এবং ১৮ দিন ২০০ এর ওপর ছিল। যেখানে ঢাকা ৩০০ এর সীমা অতিক্রম করেছিল মাত্র একবার।

গবেষকদের মতে, বায়ু দূষণের বেশ কয়েকটি নিয়ামকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হচ্ছে ফাইন পার্টিকুলার ম্যাটার বা সংক্ষেপে পিএম ২.৫। পিএম ২.৫ হচ্ছে বাতাসে মিশে থাকা অতি সুক্ষ্ম কণা যার ব্যাস মানুষের মাথার চুলের ব্যাসের প্রায় ৩০ ভাগের এক ভাগ। গাড়ি, কল-কারখানার ধোঁয়া, ইটভাটা, নির্মাণকাজ, কৃষিকাজে পোড়ানো ধুলা ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন এই কণা এতটাই ছোট যে মানুষের ফুসফুস ও রক্ত প্রবাহের গভীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী, কোনো শহর বা এলাকার বাতাসে পিএম২.৫ এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ২৪ ঘণ্টার গড় মাত্রা সর্বোচ্চ ১৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হয়, তবে সেটি এরইমধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ধরা হয়। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজশাহীর বাতাসে পিএম ২.৫ এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ৪৪৮.৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছিল, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা এর চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি।

একই সময়ে রাজশাহীর বাতাসে তুলনামূলকভাবে একটু বড় কণিকা পিএম ১০ এর সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪০৩.৪ মাইক্রোগ্রাম। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাতাসে এর ২৪ ঘণ্টার গড় পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ৪৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দূষণের কারণে হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শ্বাসযন্ত্রের রোগের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক আহমদ জয়নুদ্দীন সানি বলেন, দূষণের কারণে শিশু ও বয়স্করা এসব রোগে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে।

তিনি বলেন, গুরুতর বায়ু দূষণের দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শে ফুসফুস সম্পর্কিত রোগ যেমন- শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ যার মধ্যে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

রিকশাচালক আবুল আলিম বলেন, ‘একসময় আমরা গর্ব করতাম যে রাজশাহী ঢাকার চেয়ে পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এখন ধুলোয় প্রতিদিন আমাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বেশিক্ষণ ধুলায় রিকশা চালালে আমার চোখ জ্বলে, বুক ভারী লাগে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান সম্প্রতি রাজশাহী শহরের বায়ুর মান নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি শহরের বায়ুর মানের অবনতির জন্য অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কার্যক্রম, নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন ও শিল্প কারখানার নির্গমন এবং সবুজ স্থান ও জলাশয় কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজশাহী শহরের রাস্তা, ফ্লাইওভার এবং নতুন বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনসহ দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। এই নির্মাণ কাজগুলোতে ব্যবহৃত মাটি, বালি ও সিমেন্টসহ বিভিন্ন পদার্থ উন্মুক্ত স্থানে খোলা রাখা হচ্ছে। এছাড়াও নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও এগুলো পরিবহনে নিয়োজিত গাড়ি থেকে প্রচুর পরিমাণ দূষিত পদার্থ নির্গত হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য শহরে প্রচুর পরিমাণে গাছ কাটা ও জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। এসব বায়ুর গুণগত মান খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমেরিকার ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের যৌথভাবে পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন দশকে রাজশাহী শহরের সবুজ এলাকা প্রায় ২৬ শতাংশ এবং জলাধার ৩ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে শহরে কংক্রিটের অবকাঠামোর আয়তন প্রায় ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, শুষ্ক মৌসুমে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর কার্যকলাপের কারণে শহরের তীরবর্তী পদ্মা নদীর চরের বালুকে আলগা করে তোলে। ফলে ঝড়ো বাতাস সেই বালুকে শহরে উড়িয়ে নিয়ে নিয়ে এসে এ সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। তার মতে রাজশাহী শহরের বায়ু দূষণ কমাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ পদক্ষেপ অপরিহার্য।

তিনি বলেন, ‘নির্মাণ সাইটগুলোতে ধুলো নিয়ন্ত্রণ করা, নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখা, শহরে বেশি বেশি গাছ লাগানো, রাস্তাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানি ছিটানো ও পরিষ্কার রাখা, গাড়ি ও কলকারখানার নির্গমন কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একইসঙ্গে ছাদবাগান এবং রাস্তার দু’ধারের দূর্বা জাতীয় ঘাস বাতাসে ভেসে থাকা কণাগুলিকে আটকে রাখতে সাহায্য করে।’

তিনি আরও বলেন, উচ্চ ধূলিকণা-শোষণ ক্ষমতা সম্পন্ন উদ্ভিদ প্রজাতি দিয়ে গ্রিন বেল্ট তৈরি করা, অত্যন্ত দূষিত এলাকায় পতিত জমিতে গাছ লাগানো ও পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকা ও চরগুলোতে সবুজ বনায়ন নির্দিষ্ট পরিমাণে দূষণ কমিয়ে আনতে পারে।

এছাড়াও তিনি জেলা প্রশাসন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে একটি পাবলিক অ্যালার্ট সিস্টেম চালু করারও আহ্বান জানান, যাতে বায়ু দূষণ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছালে তারা যেন শহরের বাসিন্দাদেরকে সতর্ক করতে পারেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্মাণ কার্যক্রম এবং সবুজায়ন কমে যাওয়ার রাজশাহী শহরে বাতাসের মান খারাপ হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি এবং নির্দেশনা জারি করছি। কিন্তু একটি জাতি হিসেবে আমরা নিয়ম মানি না, যে কারণে সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, তিনি সম্প্রতি যোগদান করেছেন এবং বায়ু দূষণের মাত্রা সম্পর্কে এখনও অবগত নন।

এফএ/জেআইএম