মতামত

বাংলাদেশের ১৬ বছরের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়

গত ১৬ বছরে, বাংলাদেশ এক ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছে যার ফলে দেশ এবং সমাজের সকল স্তরে এক ধরনের বিপর্যয় ঘটে গেছে। এই সময়ে নির্বাচনি প্রহসন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, বিচারহীন গুম-খুন, দুর্নীতি, নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। কেবল রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে নয়, প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, বাহিনী, অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সামাজিক কাঠামোতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে আজ প্রতিটি নাগরিকের জীবনে এক ধরনের অস্থিরতা, ভয় এবং আস্থাহীনতা দৃশ্যমান। যেন কোন এক জাদুকর তার ভয়ংকর মন্ত্রের মাধ্যমে দেশের কাঠামোকে এবং লোভাতুর মানুষগুলিকে তার যন্তর মন্তর ঘরে ঢুকিয়ে মগজ ধোলাই করে দিয়েছিল। তার সেই ঘোর নেশা এখনও রয়ে গেছে অনেকের মাঝে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে শাসনব্যবস্থা একচেটিয়া হয়ে ওঠে। ২০১৪ এবং ২০১৮ এর প্রহসনের নির্বাচন এবং ২০২৪–২৫ সময়কালে ভোটের বৈধতা নিয়ে দেশি-বিদেশি প্রশ্ন—সব মিলিয়ে ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ জনআস্থাকে ক্ষয় করেছে। অগণতান্ত্রিক রাজনীতির একচেটিয়াকরণ, আইনের শাসন উপেক্ষা ও মানবাধিকার অবস্থা অবনতি, দুর্নীতি, অর্থনীতিতে ধস, শিক্ষাব্যবস্থার নিম্নমান, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, সামাজিক অর্ডারের অবক্ষয় – সবকিছু মিলে সার্বিক ভাবে দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোতে একটা বিরাট নেতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে যার উত্তরণ এখন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ।

রাজনীতি কীভাবে সমাজ এবং নাগরিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে?

১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসন কীভাবে আমাদের সামাজিক অর্ডার বা ভারসাম্য নষ্ট করেছে সেটা বুঝার আগে দেশের রাজনীতি কীভাবে একটি সমাজ এবং দেশের নাগরিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।

রাজনীতি সমাজের জন্য একটি ম্যাক্রো-স্ট্রাকচারাল শক্তি। এটি আইনের ধরন, শাসনের ধারা এবং সামাজিক নীতিমালা নির্ধারণ করে। যদি সরকার নিজেই নিয়ম মানে, নাগরিকও নিয়ম মানতে শিখে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি আইন ভাঙাকে বৈধতা দেয়, তখন মানুষও শর্ট্কাট শেখে(উল্টা পথে গাড়ি চলাচল, ঘুষের মাধ্যমে কাজ আদায় ইত্যাদি)। ন্যায়ভিত্তিক(সুশাসন) রাজনীতি মানুষে-মানুষে বিশ্বাস বাড়ায়; বিপরীতে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি নাগরিকদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং সংঘাত ছড়িয়ে দেয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মানুষ সক্রিয় হয়, নাগরিক দায়িত্ব নেয়। একনায়কতান্ত্রিক রাজনীতিতে মানুষ নীরব হয় বা বিদেশমুখী হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব যেমন আচরণ করে, সমাজও সেই ধাঁচে অভ্যস্ত হয়।

নাগরিক আচরণ: রাজনৈতিক প্রভাবের স্তর

যখন রাজনৈতিক পরিবেশ দমনমূলক হয়, নাগরিকরা self-censorship শিখে নেয়। তারা জানে, সত্য বললে মামলা, হয়রানি বা চাকরির ক্ষতি হতে পারে। যেমন, বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন (DSA) ব্যবহার করে বহু সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেকে সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যদি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ন্যায়বিচার না করে, মানুষ preference falsification–এ পড়ে। মানুষ ভেতরে একভাবে ভাবে, বাইরে আরেকভাবে প্রকাশ করে যা একধরনের দ্বিচারিতা। রাশিয়ায় অনেক নাগরিক ভেতরে সরকারবিরোধী, কিন্তু প্রকাশ্যে সমর্থন দেখায়—ভয়ে। একজন নাগরিক রাজনৈতিক অসন্তুষ্টি সামাল দেয় তিনভাবে। যেমন, দেশত্যাগ বা বিদেশমুখিতা, প্রতিবাদ বা আন্দোলন এবং শাসকের সাথে মানিয়ে নেয়া। যদি শাসকগোষ্ঠী নিয়ম ভাঙতে অভ্যস্ত হয়, নাগরিকরাও “ম্যানেজ কর” শিখে নেয়। দুর্নীতি তখন অপরাধ নয়, বরং সামাজিক স্বাভাবিকতা হয়ে দাঁড়ায়। আর সেখানেই বিপর্যয়।

যখন সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ম দুর্বল হয়ে যায়, তখন সমাজে এক ধরনের দিশাহীনতা তৈরি হয়। এতে অপরাধ, আত্মহত্যা এবং নৈতিক অবক্ষয় বাড়ে। যেমন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন দুর্নীতি-ঘুষকে স্বাভাবিক মনে করার প্রবণতা এর উদাহরণ। আবার সরকার যদি সামাজিক আস্থা ও নাগরিক অংশগ্রহণকে দুর্বল করে, তবে social capital ভেঙে যায়। ইউরোপীয় অনেক দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আছে, ফলে সামাজিক আস্থাও উচ্চমাত্রায়। বিপরীতে বাংলাদেশে দুর্বল রাজনীতি মানুষের আস্থা ক্ষয় করেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি নাগরিক আচরণ নির্ধারণ করে। যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থা অংশগ্রহণমূলক হয়, তবে নাগরিক সংস্কৃতিও সক্রিয় হয়।

দেশের নাগরিকদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি দুর্নীতি, ভয় এবং অবিচারের অন্ধকারে ডুবে থাকব, নাকি সাহস, ন্যায় এবং আস্থার ভিত্তিতে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলব। উত্তরণের পথ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। প্রয়োজন শুধু ঐক্য, সততা এবং এক নতুন সামাজিক সনদ-যেখানে নাগরিক ও রাষ্ট্র একসাথে মিলে একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই উন্নত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।

মানুষ যদি মনে করে তাদের মতামত সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, তারা নীরব থাকে। ফলে সমাজে এক ধরনের মিথ্যা ঐকমত্য তৈরি হয়। একনায়কতান্ত্রিক সমাজে মানুষ ভয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করে না। ফলে রাজনীতির সংকটে মানুষ হয় দেশ ছেড়ে যায়, না হয় প্রতিবাদ করে, অথবা মানিয়ে নেয়। আমাদের দেশে দীর্ঘসময়ের দুঃশাসনে এমনই একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ফ্যাসিস্ট শাসন আমাদের কি করেছে?

১) মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং প্রবল দলীয়করণঃ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যানুসারে, শত শত রাজনৈতিক কর্মী গুম হয়েছেন। অনেকে হত্যার শিকার হয়েছেন বিচারবহির্ভূতভাবে। রাষ্ট্রযন্ত্র, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি সশস্ত্র বাহিনী-ও দলীয়করণ হতে বাদ যায়নি। একদলীয় শাসনের অনুগত হয়ে পড়ে। বিরোধীদের জন্য রাষ্ট্রীয় সেবা ও ন্যায়বিচার কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ইচ্ছেমতো সংবিধান অবমাননা করা হয়েছে। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করা হয়, যা নির্বাচনী নিরপেক্ষতা নষ্ট করে দেয়।

২) আইন ও বিচারব্যবস্থার অবক্ষয়ঃ গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হলো স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। কিন্তু গত ১৬ বছরে এই খাতের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আদালত কার্যত শাসক দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার হয়েছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইন ব্যবহার করে সাংবাদিক, লেখক ও সাধারণ মানুষকে দমন করা হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চরমভাবে হরন করা হয়েছে। সরকারের ভাল লাগে না এমন কোন কথাতেই যে কেউ নিপীড়নের শিকার হয়েছে।

৩) অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও উন্নয়নের মরিচিকাঃ ফ্যাসিস্ট সরকার দাবি করেছে, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছেছে। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি জনগণকে উন্নয়নের বিভ্রমে রেখেছে। কিন্তু এর আড়ালে লুকানো রয়েছে বহু সংকট। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি হয়েছে আকাশসম। ব্যাংকলূট করা সহ, ট্যাক্স ফাঁকি, খেলাপি ঋণ কয়েক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দিয়েছে, যা ফেরত আসেনি। এই সময়ে হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলি ছিল একটা মরিচিকা এবং দারুণ অস্বচ্ছতায় ভরা। প্রকল্প ব্যয়ের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ও কমিশনভিত্তিক চুক্তি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে। উন্নয়নের সুফল কেবল একটি শ্রেণি ভোগ করেছে, ফলে ধনী-গরিব বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সাধারণ জনগণকে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও আয়হীনতার চাপে দিন কাটাতে হচ্ছে। দাম-স্ফীতি, আয়-স্ফীতি ও বৈষম্য—এই ত্রিভুজ মিলে বাস্তব জীবনযাত্রার মান কমিয়েছে। বৃহৎ অবকাঠামো “দৃশ্যমান উন্নয়ন” দিলেও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তিনির্ভরতার মতো কাঠামোগত রূপান্তর ত্বরান্বিত হয়নি—ফলে কস্ট-অব-লিভিং ক্রাইসিস দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।

৪) শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয়ঃ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার শিক্ষা। কিন্তু এই খাতেও দলীয় রাজনীতির প্রভাব মারাত্মক হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস ছিল এক প্রকার বিভীষিকাময়। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ভিন্নমত দমন করা হয়েছে। সহিংসতায় বহু শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে বা আহত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং এর ছত্রছায়ার মানুষগুলি হয়ে উঠেছিল এক একটা দানব, ফ্র্যাংকেনস্টাইন।

৫) সামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়ঃ দীর্ঘদিনের অবক্ষয় এবং অনৈতিকতার চর্চায় মানুষের মাঝে অনৈতিকতা একটা স্বাভাবিক অনুশীলনে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা এবং টাকার লোভ অধিকাংশ মানুষের স্বাভাবিক মানসিকতা হতে দূরে সরিয়ে ফেলেছে। যার থেকে এখন উত্তরণ প্রায় যুদ্ধের মত। সমাজের মৌলিক কাঠামো এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গুম, খুন ও ভয়ভীতি সমাজে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। অনেকের গায়ে জংগী লেবেল লাগিয়ে তাদের সমাজে হেয় করা হয়েছে। মানুষ এখন রাজনীতিবিদদের কথা বিশ্বাস করছে না, তাদের থেকে প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দুর্নীতি ও অনৈতিকতা এখন সামাজিকভাবে “গ্রহণযোগ্য” হয়ে উঠেছে। বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, হতাশা বেড়েছে। অনেকেই বিদেশে চলে যাওয়াকে একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখছে। আস্থা ও মূল্যবোধ ভেঙে পড়েছে, পারিবারিক ও সামাজিক সুরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কি ভয়ংকর একটা পরিস্থিতিতে আমরা এখন বসবাস করছি। একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশেও মনে হয় এমন পরিস্থিতি হয় না। সেখানে থাকে দুটি প্রতিপক্ষ ভিন্নমতের, সংস্কৃতির বা ধর্মের। কিন্তু গত ১৬ বছরে দেশের একটি বিশেষ দল, রাজনীতিবিদ, আইন-শৃংখলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই দেশের মানুষকেই প্রকারান্তে বন্দী করে রেখেছিল, আয়নাঘর বানিয়েছিল, নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল নির্দ্বিধায়।যারা আজ আয়নাঘর হতে ফিরে এসেছে তারা এবং তাদের পরিবার এক ধরনের মানসিক ট্রমাতে ভুগছে- যার রিকোভারি অতি জটিল।

৬) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নঃ ভারতের প্রতি অতিনির্ভরতা বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে। অনেক চুক্তি হয়েছে যা জনসমর্থন ছাড়াই বাস্তবায়িত হয়েছে। চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বেড়েছে, যা ভবিষ্যতে ঋণনির্ভরতা বাড়াতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে মানবাধিকার ইস্যুতে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

৭) মানবসম্পদ সংকটঃ গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মানব সম্পদ উন্নয়নও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতীয় উৎপাদনশীলতার মূল চালিকা শক্তি হলো মানবসম্পদ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত জটিল। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত ও মানসন্মত কারিকুলাম (Correct Curriculum) অভাব, উপযুক্ত শিক্ষার্থী্র( Correct Student) অভাব এবং উপযুক্ত শিক্ষকের( Correct Teacher) অভাবে ও পাঠদানের সীমাবদ্ধতার কারণে ফাউন্ডেশনাল স্কিলস দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্যাম্পাস-রাজনীতির সহিংসতা, স্বাধীন চিন্তার পরিসর সংকুচিত হওয়া( Creativity) এবং মেধা পাচার (brain drain)-এর মতো গুরুতর সমস্যা। ফলে শিক্ষা আজ আর কেবল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে কেবল সার্টিফিকেট উৎপাদনের যন্ত্র এবং সামাজিক পুঁজি ক্ষয়ের প্রতীক। এরই অন্তরালে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা চাকচিক্যে ভরা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ব্যাবসা করেছে। এই বাস্তবতায় শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমানভাবে দেখা দিচ্ছে দক্ষতার অমিল (skill mismatch)। ফলে বাজারে যে প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকে শিল্পে প্রতিষ্ঠানের চাহিদার সাথে মিলানো যাচ্ছে না (Academia-Industry gap).

৮) সামাজিক ভারসাম্যহীনতা (Imbalance of Social Order)ঃ পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম ক্রমে ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে। ব্যবসায় গড়ে উঠেছে “স্মার্ট শটকার্ট” এর সংস্কৃতি অথচ নৈতিক আয়ের পথ কঠিন হয়ে পড়েছে। সুবিধাবাদীরা বেশী সুবিধায় থেকেছে আর অন্যরা প্রায় অসহায় হয়ে পড়েছে। এর ফলে সামাজিক আস্থা (social trust) ক্ষয় হতে শুরু করেছে। আস্থা কমে গেলে প্রতিটি লেনদেনের খরচ বেড়ে যায়, যা সরাসরি অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। যুবসমাজ দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্ব, বিদেশমুখী প্রত্যাশা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের ত্রিভুজে বন্দি হয়ে পড়ছে।

উত্তরণের রূপরেখা

বাংলাদেশ আজ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সংকটে ঘেরা। এসবের সমাধান কোনো তাৎক্ষণিক উদ্যোগে সম্ভব নয়—প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত রূপরেখা, যেখানে আস্থা পুনর্গঠন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের প্রতিটি খাতকে নতুন করে সাজাতে হবে। এর জন্য যা যা করা উচিতঃ

• নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নয়নঃ গণতন্ত্রে সবচেয়ে জরুরি হলো প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, সহায়ক সরকার বা অন্তত শক্তিশালী ‘রুলস অব দ্য গেম’—যে কাঠামোই হোক না কেন, ভোটের মাঠে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ভোটিং টেকনোলজি (ইভিএম/পেপার ব্যালট) নয়, বরং পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

• আইনের প্রয়োগ এবং জবাব্দিহিতাঃ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। অপরাধ দমনে আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ, সর্বস্তরে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও শাস্তির কাঠামোতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি্তা, তাদের মাইন্ডসেট ঠিক করতে এবং সক্রিয়তা বাড়াতে স্বাধীন অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা, কমান্ড দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি। বাহিনী কোন দলের হতে পারে না। তারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষায় সক্রিয় থাকবে, সরকারের তাবেদার বাহিনীতে পরিণত যেন হয় সেই আইন চালু করতে হবে। প্রয়োজনে শক্ত হাতে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। ‘আমি আদেশ পালন করেছি’ এমন স্বীকারোক্তিতে যেন কেউ পার পেয়ে না যায়। আপরাধী যে-ই হোক অতি দ্রুত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

• অর্থনীতি সবল করাঃ অর্থনীতির হৃদপিণ্ড হলো ব্যাংকিং খাত। এখানে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে সিভিল ও ক্রিমিনাল উভয়ধারার ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংক একীভূতকরণ বা রেজোলিউশন মেকানিজম সক্রিয় করতে হবে। ব্যাংক লোনের ব্যাপারে স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

• সামাজিক আস্থা ও নৈতিক অর্থনীতিঃ সামাজিক আস্থা পুনর্গঠনের জন্য কিছু মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। প্রথমত, হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে দুর্নীতি প্রকাশে আগ্রহীরা নিরাপদ থাকে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি চুক্তি ও ক্রয়-প্রক্রিয়ায় অ্যান্টি-করাপশন ধারা যুক্ত করা জরুরি। তবে কেবল আইন ও প্রযুক্তিগত কাঠামোই যথেষ্ট নয়; সামাজিক আস্থা গড়ে তুলতে প্রয়োজন শক্তিশালী সফট ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এর মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি–পুলিশিং, যাতে জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা তৈরি হয়; লিগ্যাল এইড সেবা, যাতে সাধারণ মানুষ সহজে ন্যায়বিচার পেতে পারে; এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, যা একটি সুস্থ ও নৈতিক সমাজ গঠনে অপরিহার্য।

• আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিঃ বাংলাদেশের আইন–শৃঙ্খলা ভয়াবহ। একদিকে সাধারণ অপরাধ যেমন—চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি এখনও বিদ্যমান, অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ যেমন সাইবারক্রাইম, আর্থিক প্রতারণা ও ডিজিটাল হ্যাকিং দ্রুত বাড়ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালান সমাজে অস্থিরতা তৈরি করেছে। এছাড়া দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং পুলিশ–প্রশাসনের জবাবদিহিতার সীমাবদ্ধতা আইন–শৃঙ্খলা রক্ষায় বড় বাধা হয়েছে। মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ায় দেরি, সাক্ষীর নিরাপত্তার অভাব, ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বিদ্যমান রয়েছে। আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী দায় সারা ভাবে কাজ করছে যেন কোন জবাবদিহিতা নেই। এই অবস্থার উন্নয়নের জন্য অতি দ্রুত আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অপরাধে দায়মুক্তি সংস্কৃতি ভাঙাতে হবে। স্বাধীন অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর কমান্ড পর্যায়ে বিশেষ পরিবর্তন আনতে হবে।

পরিশেষে, বাংলাদেশে গত ষোলো বছরের ফ্যাসিস্ট শাসন শুধু রাজনৈতিক কাঠামোকেই বিপর্যস্ত করেনি, বরং সমাজের অন্তর্গত নৈতিক শক্তি, আস্থা এবং মূল্যবোধকেও ক্ষয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র যখন নাগরিকের নিরাপত্তা ও ন্যায়ের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ ধীরে ধীরে ভয়ার্ত, ভরসাহীন, নীরব ও দিশাহীন হয়ে পড়ে। এভাবে সামাজিক কাঠামো ভেঙে গেলে গণতন্ত্র কেবল কাগজে-কলমে থেকে যায়, বাস্তবে আর কার্যকর হয় না।

তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—কোনো জাতি দীর্ঘকাল দমন-পীড়ন, ভণ্ডামি ও ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। মানুষের ভেতরের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, ন্যায়বিচারের তৃষ্ণা এবং সামাজিক ন্যায্যতার দাবি একদিন অবশ্যম্ভাবীভাবে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করে যার প্রতিফলন আমরা জুলাই-এর আন্দোলনে দেখছি। অবাক করার বিষয় হলো আমাদের জেন-জে এর জুলাই আন্দোলন এর ধারণা এখন অঙ্কে দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। আজ বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো—আস্থা পুনর্গঠন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে পুনরুজ্জীবিত করা। দেশের নাগরিকদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি দুর্নীতি, ভয় এবং অবিচারের অন্ধকারে ডুবে থাকব, নাকি সাহস, ন্যায় এবং আস্থার ভিত্তিতে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলব। উত্তরণের পথ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। প্রয়োজন শুধু ঐক্য, সততা এবং এক নতুন সামাজিক সনদ-যেখানে নাগরিক ও রাষ্ট্র একসাথে মিলে একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই উন্নত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।

সূত্র ও রেফারেন্সঃ • ২০১৪ নির্বাচন (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ১৫৩ আসন): Wikipedia summary with EC/NYTimes refs. • Human Rights Watch, Jan 2, 2019 • ২০১৮ অনিয়মে ACC–এর তদন্ত (২০২৫ জানুয়ারি): Dhaka Tribune.• Zombie Cyber Security Law বিশ্লেষণ (নভেম্বর ২০২৪) • RAB এর বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা (১০ ডিসেম্বর ২০২১)• ব্যাংকখাত সংকট: The Daily Star citing ADB (Sep 5, 2025); CEIC (Sep 2024); TBS (Jun 15, 2025). • World Bank–এর সহায়তা ও সংস্কার–কথোপকথন (২০২৪–২৫): Reuters (Sep 17, 2024); Reuters (Apr 24, 2025).• Learning Poverty & Education: World Bank Bangladesh Learning Poverty Brief।• https://www.youtube.com/watch?v=x9yZNU45Nk4

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।

এইচআর/এমএস