জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জামানত কমানো, নির্বাচনি ব্যয় মনিটরিং এবং প্রশাসনের ওপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনে আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে বিভিন্ন দলের নেতারা এমন সুপারিশ করেন।
সংলাপে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রার্থীদের ব্যয়সীমা। নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের জন্য একটি নির্ধারিত ব্যয়সীমা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে এই ব্যয়সীমা কতটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব- তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এরই মধ্যে আমরা দেখছি কিছু রাজনৈতিক দল কোটি কোটি টাকা খরচ করে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে, যা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন হলো এই অতিরিক্ত ব্যয় কমিশন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? যদি বলা হয় তফসিল ঘোষণার পর হিসাব নেওয়া হবে, তাহলে নির্বাচনের আগেই যে শত শত কোটি টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে- সেটি তো গণতন্ত্রের ন্যায়সংগত প্রতিযোগিতাকে বিকৃত করছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এখনই কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে এবং নেওয়া উচিত। এ সময় তিনি জামানত কমিয়ে ৫ হাজার টাকা করার দাবি তোলেন।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ কাফি রতন বলেন, এক উপজেলা ভোটে অন্য উপজেলা থেকে ভোট কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া, নির্বাচনে কালো টাকার খেলা, পেশিশক্তির খেলা, ধর্মের অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক কারসাজি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, আমরা মনে করি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা। এছাড়া টাকা-শক্তি, পেশিশক্তি, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা ও প্রশাসনিক কারসাজিমুক্ত নির্বাচনি পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সবার ভোট দেওয়া ও প্রার্থী হওয়ার সমান অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এগুলো নিয়ে আলোচনা, মতামত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা কী হয়েছে- তা এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। জামানত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জাতীয় সংসদকে অতীতের মতোই কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত করবে। এছাড়া, না ভোটের বিধান সব আসনেই থাকা জরুরি।
তিনি বলেন, এখন এআই ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এআই-জেনারেটেড ফেক নিউজ, চরিত্রহননমূলক প্রচারণা- এসব মোকাবিলা করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। আমরা নিজেরাও ভেবে কুল পাচ্ছি না। অঙ্গীকারনামায় বলা আছে- এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীর চরিত্রহনন করবে না। কিন্তু বাস্তবে তা রোধ করা কঠিন। তাই এটা মোকাবিলায় কার্যকর উপায় বের করতে হবে।
আরও পড়ুনআট বিভাগে আটদিনে ভোটগ্রহণের প্রস্তাব ইসিতেগণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত ‘না’ হলে কী হবে
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জিএসডি) সিনিয়র সভাপতি তানিয়া রব বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে আমরা যখন নির্বাচন করতে যাই, তখন প্রশাসনিক কিছু অসামঞ্জস্যতা ও জটিলতা লক্ষ্য করি। বলা হয়, নির্বাচনকালে প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। ফলস্বরূপ, নির্বাচনের দিন প্রার্থী এবং প্রার্থীর কর্মীরা প্রায়ই হয়রানির শিকার হন।
আমার নিজস্ব নির্বাচনি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও অনেক সময় সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। কোনো সমস্যা বা দুর্ঘটনা ঘটলে বলা হয়, ‘ম্যাজিস্ট্রেটকে বলুন’ বা ‘অমুক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন’- কিন্তু তখন মাঠপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে, প্রার্থী ও ভোটার উভয়েই ভোগেন মারাত্মক হয়রানিতে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, কোনো অযৌক্তিক চাপের কাছে আপনারা নতি স্বীকার করবেন না। দৃঢ়চিত্ত, বলিষ্ঠ ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে আমরা দেখতে চাই। জামানত পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে রাখা উচিত।
তিনি বলেন, প্রার্থীর সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা প্রায় দ্বিগুণ (৫০ লাখ টাকার বেশি) করার প্রস্তাব এসেছে। আমরা মনে করি, এটি সংসদকে ধনী, বিত্তবান, লুটেরা ও মাফিয়াগোষ্ঠীর ক্লাবে পরিণত করবে।
সাইফুল হক আরও বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে আনতে হবে। কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। এটা আপনাদের জুরিসডিকশনের মধ্যেই পড়ে। প্রয়োজনে আলোচনার মাধ্যমে আরও বিষয় বিবেচনায় নেওয়া দরকার। অন্যথায় আস্থা তৈরি হবে না। পোস্টার নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত, নির্বাচনে পোস্টার দেওয়ার বিষয়টি আকস্মিকভাবে বাতিল করা হয়েছে- এটি ভুল সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, আমরা বারবার বলেছি ৩০০ আসনেই ‘না ভোট’ রাখার বিধান থাকা দরকার। কারণ ভোটাররা পাঁচজন প্রার্থীর কাউকেই পছন্দ নাও করতে পারেন। ‘না ভোট’ সবচেয়ে গণতান্ত্রিক বিকল্প।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে সংলাপে অন্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব উপস্থিত ছিলেন।
এমওএস/কেএসআর/এমএস