ফিচার

‘এমএ পাস চাওয়ালা’র সাফল্যের গল্প বললেন সহিদুল

মো. আশরাফুল ইসলাম আকাশ

এমএ পাস চাওয়ালার বয়স দুই বছর হয়ে গেছে। এর মধ্যে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাকে! কখনো এসেছে আত্মসম্মানের প্রশ্ন, কখনো বা আত্মীয়তা ছিন্নের ভয়! কিন্তু কোনো কিছুই দমাতে পারেনি উদ্যোক্তা মোহা: সহিদুল ইসলামকে। পাহাড়সম সব বাধাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন তিনি। রাজধানীর ১০০ ফিট, গুলশান ও মিরপুরের চা প্রেমীদের বুদ করে রেখেছেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে এমএ পাস চা ওয়ালাতে ভিড় করেন ক্রেতারা। কাঠখড় পুড়িয়ে সাফল্যের সন্ধান করা সহিদুলের গল্প শুনেছেন আশরাফুল ইসলাম আকাশ-

কর্মজীবনের শুরু থেকেই শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন মোহা: সহিদুল ইসলাম। করোনাকালে অনলাইন স্কুল খুলে বসেন তিনি। সেই দফায় ৮ মাসে ৩৫ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয় তাকে। এরপর মানসিক অবসাদে ডুবে যান। বেছে নিতে চেয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ। কিন্তু বুঝতে পারেন এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। সেই চেষ্টা থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজতে থাকেন তিনি। মূলত তখনই চা পানীয়র ব্যবসার ভাবনা আসে তার। যেই ভাবনা, সেই কাজ। ২০২৩ সালের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হলো এমএ পাস চাওয়ালার যাত্রা।

শিক্ষাজীবনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন সহিদুল। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ছেলে চা পানীয়র ব্যবসা করবেন মেনে নিতে পারছিলেন না তার মা। তার চেয়েও তিক্ত কথা ধেয়ে আসলো স্ত্রীর অভিজাত পরিবার থেকে। পরিবারের কেউ একজন চা দোকান করবেন, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি শ্বশুড়বাড়ির আত্মীয়রা। হুমকি আসে সম্পর্ক ছিন্নর! কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চললেন সহিদুল।

সবকিছু হারিয়ে অনেকটা শূন্য হাতেই ঢাকার ১০০ ফিটে এমএ পাস চা ওয়ালার আত্মপ্রকাশ হলো। নগরের ব্যস্ততা থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় তরুণ-তরুণীদের আড্ডাস্থল হয়ে উঠেছে ১০০ ফিট। সেই সুযোগটাই নিলেন সহিদুল। চায়ের স্বাদে ভিন্নতা এনে ক্রেতাদের মুখে মুখে ঠাঁই পেল তার প্রতিষ্ঠান। কয়েক মাসের ব্যবধানেই গুলশান ও পরে মিরপুরে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এখন তার প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ জন শিক্ষার্থীর। এদের কেউ পূর্ণকালীন কেউবা পার্ট-টাইম চাকরি করছেন।

প্রতিষ্ঠানের নামেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে চায়ের আধিপত্য রয়েছে। সাধারণ লাল চা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চা বিক্রি হচ্ছে এখানে। তবে মসলা মেশানো মিক্সড চা ও চিকেন সিঙাড়া ক্রেতাদের বুদ করে রেখেছে। এর বাইরে পোড়া রুটি, শর্মা, গার্লিক চিকেন, চিকেন বল, চিকেন ফিংগার, বার্গারসহ সাব স্যান্ডুইচের স্বাদ নেওয়া যাবে এখানে। পাশাপাশি শরীর জুড়ানো শেক ও মকটেল জাতীয় পানীয়ও বিক্রি করছেন উদ্যোক্তা সহিদুল।

নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে এমএ পাস চা ওয়ালার অন্দরেও রুচির আভাস দেওয়া হয়েছে। কাঠের টেবিলের আর বাঁশ-বেতের মোড়ায় বসে চায়ের চুমুকে আড্ডায় মেতে ওঠেন ক্রেতারা। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে দুই চাকার সাইকেলের চাকা আর চেইনের দারুণ এক নকশা। খুব ছিমছাম আয়োজনে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই এমন চেষ্টা উদ্যোক্তার।

নামেই বাজিমাত করেছেন সহিদুল। উদ্যোক্তা হিসেবে বাজারে আসার পর এখন পর্যন্ত অসংখ্য প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি। নিজের ব্র্যান্ড বিক্রি করলেই পেতেন কোটি কোটি টাকা। তবে সেই পথে না হেঁটে ধীরে ধীরে নিজেই এগোনোর সংকল্প করেন। শূন্য থেকে শুরু করে এখন ৩টি শপ চালাচ্ছেন। আগামীতে চেইন বিজনেসের মাধ্যমে সারাদেশে নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।

সহিদুল বলেন, ‘স্বনামধন্য অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে এমএ পাস চা ওয়ালার আউটলেট চেয়েছে। বিনিময়ে তারা কাড়ি কাড়ি টাকা দিতে চেয়েছে। আমি তাতে রাজি হইনি। কেননা আমি নিজেই এটি ব্র্যান্ডে পরিণত করতে চাই।’

উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতা পেলেও এখানেই থামতে চান না সহিদুল। সর্বোচ্চ ৫০ হাজার কাপ চা বিক্রি করে নাম লেখাতে চান গিনেস বুক অব রেকর্ডসে। এজন্য বড় প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছেন তিনি। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের শেষ দিকে এই আয়োজন করতে চান সহিদুল। তার কথায়, এর আগে সর্বোচ্চ চা খাওয়ানোর রেকর্ডে জাপান ও ভারতের দুজন ছিলেন। তাদের রেকর্ডটি নিজের নামে করে নিতে ১ টাকায় ৫০ হাজার কাপ চা পান করিয়ে রেকর্ড বুকে জায়গা করে নিতে চান।

যে বাস্তবতায় নিজে সফল হয়েছেন, তা অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে চান সহিদুল। এজন্য ‘এসো অল্প পুজিতে চা কফির দোকান দিয়ে স্বাবলম্বী হই’ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তিনি। নামমাত্র পারিশ্রমিক নিয়ে বেকার যুবকদের চা পানীয়র ব্যবসায়ে সাহস যোগাচ্ছেন। হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন এই ব্যবসার আদ্যোপান্ত। এ পর্যন্ত হাজারের বেশি যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।

চায়ের ব্যবসায় নেমে শুরুতে অনেক নিন্দনীয় কথা শুনতে হয়েছে সহিদুলকে। তবে তিনি কখনো হার মানেননি। উদ্যোক্তা জানালেন, প্রতিটি উদ্যোগই ঝুঁকিপূর্ণ। আপনাকে শুরুতেই কোটি টাকার ব্যবসায় করতে হবে, এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের কাছে যা আছে তা দিয়েই শুরু করতে হবে। অনেক বাধা আসবে, সেসব পাশ কাটানো যাবে না। সামনে থেকে মোকাবিলা করতে হবে। তাহলে যত জটিলতাই আসুক, কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

আরও পড়ুনযে হাটে সংসারের গল্প বিক্রি হয় রঙিন পসরা সাজিয়েনলকূপের পানি শীতে গরম, গরমে ঠান্ডা থাকে কেন?

কেএসকে/এমএস