আলো-ঝলমলে দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতো চলে গেল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আর্কা ফ্যাশন উইক হয়ে উঠেছিল যেন জেন জি ও জেন আলফা-ফ্যাশনপ্রেমীদের মিলনমেলা। ছিলেন মিলেনিয়ালসহ নানা বয়সী মানুষও। কী দেখে ফিরলেন তারা?
শেষ হলো আর্কা ফ্যাশন উইকের চতুর্থ আয়োজন। প্রথম দিন থেকেই দর্শনার্থীদের ফ্ল্যাশ রানওয়ে থেকে ডিজাইনার ও ব্র্যান্ডের কালেকশনের র্যাম্প শো, মাস্টারক্লাস, কনসার্ট এবং ডিজি পার্টি – সবকিছুই মুগ্ধ করেছে দর্শনার্থীদের। এ কদিন ফ্যাশন উইক যেন হয়ে উঠেছিল এক স্বপ্নরাজ্য, যেখানে স্টাইল ও সৃজনশীলতার মিলনে প্রতিটি মুহূর্ত নতুন উদ্দীপনা যোগ করেছে।
দর্শনার্থীদের পোশাকের ধরনেও দেখা গেছে বৈচিত্র্য। এই মৌসুমে ফ্যাশনের এক বৈচিত্র্যময় দৃশ্য ফুটে উঠেছিল সেখানে। মডেস্ট ফ্যাশন থেকে শুরু করে সমসাময়িক স্ট্রিট স্টাইল, ঐতিহ্যবাহী পোশাক থেকে টেকসই নকশা, যা বাংলাদেশের সৃজনশীল পরিচয়কে বিভিন্ন ধারা এবং প্রজন্মের মধ্যে কীভাবে প্রসারিত হচ্ছে তা ফুটিয়ে তোলে।
পুরো অনুষ্ঠান জামদানি মোটিফ ব্র্যান্ডিং, রানওয়ে নির্দেশনা এবং ভেন্যু ডিজাইনের পেছনের গল্প বলেছে। আড়ংয়ের সহযোগিতায় কারুশিল্পের উদযাপন আরও গভীর হয়েছে, যেখানে ছয় জন দক্ষ কারিগর জামদানি, মৃৎশিল্প, নকশি-কাঁথা, কারচুপি, রিকশা পেইন্টিং এবং রেশম চাষের কৌশল সরাসরি দেখিয়েছেন। ফলে দর্শকরা বাংলাদেশের ফ্যাশন সংস্কৃতির শিকড় নিজ চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছেন।
প্রথম দিনে মডার্ন থিমের র্যাম্প শো প্রথম দিনের থিম ছিল ‘মডার্ন’, যেখানে আধুনিকতা ও সমসাময়িক স্টাইলের নিখুঁত সমন্বয় ফুটে ওঠে। দিনের প্রথম স্লটে রানওয়েতে অংশ নেয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড সিজ এবং স্লাইউইন। এরপর একে একে মঞ্চে আসে রানোউ, গ্রীষ্ম, রয়েল বাংলা কতুর এবং পৌষ। সন্ধ্যার সমাপনী শো হয় দানিয়া ও কাঁঠালের মনোমুগ্ধকর কালেকশন দিয়ে।
পোশাকের ধরন ছিল রঙিন ও বৈচিত্র্যময় প্যাচওয়ার্কের লেহেঙ্গা, শর্ট ড্রেস, ক্রপ জ্যাকেট, কোরসেট শাড়ি, ক্রপড শার্ট-বটম, স্লিভলেস ও স্ট্র্যাপলেস গাউন, ওয়ান শোল্ডার মিনি ড্রেস এবং মিনি স্কার্টসহ নানা ধরনের পোশাকে। স্লাইউইনের কালেকশন ছিল চোখ ধাঁধানো, যেখানে ভিডিও গেমস ও হাইফ্যাশনের মিশ্রণ দেখা গেছে।
রানোউয়ের শোতে বিভিন্ন ধরনের গাউন দেখা যায় – কেপসহ স্ট্র্যাপলেস, ফ্লেয়ারড কোরসেট, প্লিটেড ও অ্যাসিমেট্রিক কাটের গাউন।
গ্রীষ্মের কালেকশন ছিল টেকসই ফ্যাশনকে কেন্দ্র করে, মোনোক্রোম থিমে সাদা, কালো, অলিভ ও ন্যুড শেডের পোশাক উপস্থাপন করা হয়। পৌষের কালেকশন ছিল মেয়েদের ওয়েস্টার্ন আউটফিটে সাজানো, আর রয়্যাল বেঙ্গল কতুরের ফ্যাশনে ছেলেদের ট্রেন্ডি ব্লেজার, স্যুট ও ক্রপড জ্যাকেট এবং মেয়েদের ক্রপড ও ওভারসাইজড ব্লেজার, পাফার জ্যাকেট তুলে ধরা হয়।
রানওয়েতে পোশাকের জমিনে চোখ ধাঁধানো অর্নামেন্টেশন, পাথর, সিকুইন এবং সেফটিপিনের ব্যবহার ছিল নজর কাড়ার মতো। দানিয়ার থিম ছিল ‘হাইস্কুল’, যেখানে স্ট্রিট কালচার এবং হাইফ্যাশনের মিশ্রণ ফুটে উঠেছিল। কাঁঠালের শোতে দেখা গেছে নাটকীয় ও স্টাইলিশ আউটফিট, যা জেন-জিদের পছন্দে সাজানো হয়েছিল – শিয়ার টপ, মিনি স্কার্ট, জ্যাকেট, বডিকন ফিট ক্রপড টপ, অ্যাসিমেট্রিক ট্যাংক টপ, ক্রপড হুডি, পাফার জ্যাকেট, টি-শার্ট, ডেনিম জ্যাকেট এবং প্যান্টস। প্রতিটি আউটফিট যেন ছিল আধুনিকতা ও স্টাইলের নিখুঁত সমন্বয়।
প্রথম দিনের শো ছিল বৈচিত্র্যময়, রঙিন এবং স্মরণীয়, যেখানে আধুনিকতা, ঐতিহ্য এবং টেকসই ফ্যাশনের সমন্বয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।
দ্বিতীয় দিন হেরিটেজ থিমে ফ্যাশন ও ঐতিহ্যের মিলন
হেরিটেজ থিমে আর্কা ফ্যাশন উইকের নানা আয়োজন দর্শকদের উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তুলেছিল। মাস্টারক্লাস, স্টুডেন্ট রানওয়ে এবং জমজমাট ফ্যাশন শোতে সৃজনশীলতার ছোঁয়া স্পষ্ট থাকলেও, ফ্যাশন রানওয়েতে এর প্রতিফলন তেমন দেখা যায়নি।
সকালে শিল্পী মেহেদী হাসান রবি ‘ওরিগামি টু টেক্সটাইল, ট্রান্সফরমেশন সারফেসেস’ শিরোনামের মাস্টারক্লাস পরিচালনা করেন। তিনি দেখান কাগজের অরিগামি নকশা কীভাবে টেক্সটাইল সারফেসে রূপান্তরিত করা যায়।
মেকআপ আর্টিস মায়েশা আসমিতা ‘সেট আপ ইওর গ্ল্যাম: এ গাইড থ্রু ফ্ললেস মেকআপ’ শিরোনামের মাস্টারক্লাসে অংশগ্রহণকারীদের নিখুঁত গ্ল্যাম লুক তৈরির কৌশল শেখান।
এ দিনের প্রথম ফ্যাশন শো শুরু হয় স্টুডেন্ট রানওয়ে দিয়ে, যেখানে উদীয়মান ডিজাইনারদের সংগ্রহ উপস্থাপন করা হয়। বিকেলে হয় ভেনোরি এবং কায়ভোর শো। সন্ধ্যায় দুটি স্লটে অনুষ্ঠিত হয় জেন্টলম্যানস’ ওয়ারড্রোব ও ইন্টেব্লু শো। দিনের শেষ পর্বে ছিল গুজেল ও তানের উপস্থাপনা। পুরো দিনটি সুরের মুর্ছনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে
শেষ দিন সাসটেইনেবল স্টাইল ও ঝুরাহর প্রথম রানওয়ে জাদু
প্রথম দুদিনের মতো ফ্যাশন উইকে ভিড় বাড়ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঢল নামে। ফ্যাশনপ্রেমী ও ফ্যাশনিস্তাদের জন্য বিকেলে সেখানে পা ফেলার জায়গা ছিল না।
শেষ দিনের থিম ছিল ‘সাসটেইনেবলিটি’। এই থিম কেবল আয়োজনের বৈচিত্র্যই দেখায়নি, বরং দেশের ঐতিহ্য, অভিনবত্ব ও পরিবেশের প্রতি অনুরাগকেও তুলে ধরেছিল। ক্যানভাস রানওয়ে মাতিয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা। প্রথমবারের মতো মোডেস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ড ঝুরাহ রানওয়েতে অংশ নিয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
সত্তার রানওয়ে উপস্থাপনায় দেখা গেছে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের শার্ট, কামিজ, শর্ট টপ এবং হাতের কাজের কাফতানে সাজানো কালেকশন। প্রতিটি পোশাকই দর্শকের নজর কাড়ে, যেখানে সাস্টেইনেবল ফ্যাশন ও দেশীয় কারুকার্য একসঙ্গে ফুটে উঠেছে।
ফ্যাশন, ফ্লেভার ও ফ্যাস্টিভিটি আর্কা ফ্যাশন উইকের ফুড কোর্ট এবারের আয়োজনকে করেছিল আকর্ষণীয়। সেমিনার, মার্কেটপ্লেস, ফ্যাশন শো ও ডিজাইন ল্যাবের সঙ্গে সঙ্গে এখানে বৈচিত্র্যময় সব খাবারের আয়োজন ছিল। স্ট্রিট ফুড থেকে শুরু করে কোরিয়ান ফ্লেভার সবই পাওয়া গেছে একছাদের নিচে। দোতলার ‘ফুড জোনে’ ভোজনরসিকরা মুখরোচক খাবার উপভোগ করেছেন। ক্যাফে প্রেমীদের জন্য ছিল অ্যারাবিকা কফির হট কফি, কোল্ড কফি, ফ্র্যাপে এবং শেকস।
ডেজার্ট ছিল চোখে পড়ার মতো। ফ্রেঞ্চ ম্যাকারুন, টার্ট, কাপকেক, বাস্ক বার্ন্ট চিজকেকসহ নানা ফিউশন ডেজার্ট উপভোগ করেছেন দর্শকরা। মেক্সিকান খাদ্যপ্রেমীরা ভিড় করেছেন নাচো চিপস, বিফ ও সাওয়ার ক্রিমের সঙ্গে সার্ভ করা চিপস প্যাকেটে।
কড়া ফ্রাইতে তৈরি কর্নডগ-অর্ধেক চিকেন, অর্ধেক চিজ-সবচেয়ে সমাদর কুড়িয়েছে। হালকা নাস্তা ও ডেজার্টের জন্য দর্শকরা কোনা ক্যাফেতে ভিড় করেছেন। এখানে ছিল রোস্ট বিফ স্যান্ডউইচ, চিকেন স্যান্ডউইচ, কোনা ক্লাব স্যান্ডউইচ, ক্যারামেল ক্রসোন্ট, চিকেন মাশরুম পাই।
আর্কা ফ্যাশন উইক কেবল পোশাক দেখানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রতি সন্ধ্যায় খাবারের স্টল, লাইভ মিউজিক এবং অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে অনুষ্ঠানস্থলটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। সব মিলিয়ে সেখানে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যা শুধু ফ্যাশন নয়, বরং বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বৃহত্তর সৃজনশীল পরিমণ্ডলকেও উদযাপন করে।
আরও পড়ুন তরুণ সৃজনশীলতার ঝলক প্রথম দিনে হালকা শীতে যেসব পোশাকে দেখাবে স্টাইলিশ
এসএকেওয়াই/আরএমডি