সরকারের খাদ্য বিতরণ কর্মসূচিতে চার ধাপে কারচুপি হয় বলে অভিযোগ করেছেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর। এজন্য করোনাভাইরাস মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিশেষ সহায়তা ডিজিটাল মাধ্যমে সরাসরি সরকার থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে পৌছে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
করোনাভাইরাসের ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারের ঘোষিত বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে মঙ্গলবার (৯ জুন) সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংলাপে এসব কথা বলেন আহসান এইচ মনসুর।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘খাদ্য বিতরণের যে কর্মসূচিগুলো আছে সরকারের, সেখানে চার ধাপে করাপশন (দুর্নীতি) হয়। খাবার কেনার সময়, খাবার মজুত করার সময়, খাবার বিতরণের সময় এবং তারপর খাবার কাকে দিল বা দোকানে বিক্রি করে দিল কি-না, শেষ ধাপ যেটা, সেখানেও বিরাট কারচুপি হয়।’
এ সমস্যা সমাধানে সরকার থেকে সরাসরি ব্যক্তির কাছে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। এই পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সরকার একটি এসএমএস নম্বর দিয়ে দিতে পারে। যেখানে বেকার হওয়া ব্যক্তি তার ন্যাশনাল আইডি নম্বরসহ এসএমএস দিয়ে জানাবেন তিনি কোথায় চাকরি করতেন। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের মোবাইল নম্বর, পরিবারের সদস্যদের নাম, ন্যাশনাল আইডি অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদ দেবেন। এর ফলে সরকার সহজেই ভেরিফিকেশন করে নিতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি লোক বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার দিয়ে যে তালিকা করা হয়, সেটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এটাতে একেবারে ভুলভ্রান্তিতে ভরা। আমি আমার গ্রামের একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, ৪২০ জনের নাম ছিল। থানা অফিসার আমাদের একজনকে ডেকে তালিকা ভেরিফাই করে দিতে বলেন।’
‘দেখা যায় ৪২০ জনের মধ্যে শুধু চারজন গ্রামের লোক আছেন। বাকি ৪১৬ জন সেখানে নেই এবং ওই নামে গ্রামে কোনো ব্যক্তিও নেই। পরে থানার অফিসার এটা বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি নিজে এসে ভেরিফাই করে দেখলেন, আসলেই চারজন আছেন। এই হলো অবস্থা। এ ধরনের তালিকা করে আমরা বেশি দূর যেতে পারব না’ বলেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক।
তিনি বলেন, ‘যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, চাকরি হারিয়েছেন, তাদের জন্য একটা বিশেষ প্রোগ্রাম বা প্যাকেজ করতে হবে। যার মাধ্যমে তাদেরকে সাপোর্ট দেয়া যেতে পারে। সেজন্য একটা ফান্ড করা দরকার এবং এই বাজেটেই সেটা থাকা উচিত। আমাদের হিসাবে এসএমই খাতে থেকে প্রায় ৭০ লাখ বেকার হয়ে গেছেন। লকডাউন তোলার পরে রিকশাচলকরা হয়তো রিকশাটা চালাচ্ছে, কিন্তু সেইভাবে আয় হচ্ছে না। যারা বাদাম বিক্রি করতো তারা হয়তো কাজ শুরু করতে পারে, কিন্তু আগের মতো আয় হচ্ছে না। আমাদের প্রস্তাব প্রায় দেড় কোটির মতো পরিবারকে সাপোর্ট দেয়া দরকার।’
বড় শিল্পের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বড় শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার যে ঋণ দেয়া হচ্ছে সেখানে সাবধান হতে হবে। ঋণ খেলাপীদের বাদ দেয়া হচ্ছে না। একই সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালকরাও বড় ঋণ গ্রাহক। এই জায়গাতেও সাবধান হতে হবে। তা না হলে এই ৩০ হাজার কোটি টাকা এরাই খেয়ে ফেলতে পারে। সে জন্য মনিটরিং কমিটি করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার কোটি টাকা অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগেুলোকে দেয়া হবে মাইক্রো ক্রেডিট ফাইন্যান্সের মাধ্যমে। সেটা ঠিক আছে। এই টাকা বাদ দিয়ে যেটা থাকবে তা এসএমই খাতের জন্য পর্যাপ্ত না। এখানে প্রায় ৭০-৮০ লাখ লোক কাজ করে এবং একটা বিশাল জনগোষ্ঠী। অল্প অল্প করে অনেক টাকা লেগে যায়। এই জায়গায় সরকারকে আর একটু উদার হতে হবে আগামীতে। ২০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে শুরু করা হোক, কিন্তু পরবর্তীতে হয়তো টাকার অংক বাড়াতে হবে।’
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ঠিকমতো বিতরণ হচ্ছে কি-না, তা মনিটরিং করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকার্স এবং কিছু ট্রেডবডি নিয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি সেক্টরে ঋণের প্রবাহটা ঠিকমতো হচ্ছে কি-না, তা মাসিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে। টাকা বিতরণ না হলে কোথায় সমস্যা? কোন সেক্টরে সমস্যা? তা নির্ণয় করে, সেখান থেকে উত্তরণের দায়িত্ব হবে এই কমিটির। আমি মনে করি, যতদ্রুত সম্ভব এটা করা দরকার।’
এমএএস/এসআর/এমকেএইচ