মতামত

উন্নয়নের আরেক সুফল : বাড়ছে চীনাদের গড় উচ্চতা

চীন সম্পর্কে যাদের জানাশোনা কম, তারা এদেশে এলে অনেককিছু দেখে ও শুনে অবাক হবেন। আমিও হয়েছিলাম। বিগত সাড়ে আট বছরে চীনে অনেককিছু দেখে ও শুনে অবাক হয়েছি। তেমন দু’টি অভিজ্ঞতার কথা বলি। এর মধ্যে একটির সঙ্গে খোদ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের তৎকালীন (১৯৭৮ সাল) অবস্থা জড়িত।

২০১২ সালে চীনে এসে কর্মস্থলে (চীন আন্তর্জাতিক বেতার) সহকর্মী হিসেবে যাদের পেয়েছিলাম, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন চিয়াং চিন ছেং। আমাদের প্রিয় চিয়াং ভাই। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। বছরের অধিকাংশ সময় স্ত্রী-মেয়ে ও নাতি-নাতনিকে নিয়ে সময় কাটে তার সুদূর কানাডায়। বাঁশি বাজাতে পছন্দ করেন। তিন ধরনের বাঁশি বাজাতে পারেন। কানাডায় প্রবাসী প্রবীণ চীনাদের নিয়ে এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন একটি ব্যান্ড। মাঝে মাঝে আমাকে নিজেদের পারফরমেন্সের ভিডিও ক্লিপ পাঠান। তো, চিয়াং ভাইয়ের অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ নামের একটি ২০ মিনিটের অনুষ্ঠান করতাম আমি। অনুষ্ঠানের দশ মিনিট তাঁর, দশ মিনিট আমার। তাঁর দশ মিনিটে স্থান পেত চীনা সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং আমার দশ মিনিটে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি। অনুষ্ঠানটি শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল যেসব কারণে, তার একটি কারণ ছিল ‘চীনের দার্শনিক গল্প’ পর্বটি। প্রতি অনুষ্ঠানে তিনি একটি করে দার্শনিক গল্প বলতেন। প্রতিটি গল্প ছিল শিক্ষণীয় ও আকর্ষণীয়।

কিন্তু এসব গল্প শুনে অবাক হইনি। বাংলাদেশে আমরা এ ধরনের গল্প শুনে ও পড়ে অভ্যস্ত। অবাক হয়েছিলাম তাঁর কাছে বাংলাদেশের গল্প শুনে। তিনি বাংলাদেশে প্রথম গিয়েছিলেন ১৯৭৮ সালে। ঘটনাচক্রে সে-বছরই চীনে তৎকালীন শীর্ষনেতা তেং সিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল সংস্কার আন্দোলন। পাশাপাশি শুরু হয়েছিল চীনকে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়া; ‘ব্যাম্বু কার্টেন’ তুলে দেওয়ার আয়োজন। তো, ঠিক সেই বছর চিয়াং ভাই বাংলাদেশে গেলেন এবং বিমান থেকে নেমে অবাক হলেন। তার অবাক হবার কথা শুনেই আমার অবাক হবার পালা।

তখন আজকের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছিল না। ছিল সবেধন নীলমণি তেজগাঁও বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরকে আমি খুব ভালো করে চিনি। বলতে গেলে আত্মার সম্পর্কই ছিল এর সঙ্গে। বাবা সিভিল এভিয়েশনে চাকরি করতেন এবং আমি স্টাফ ওয়েল ফেয়ার হাই স্কুলে (এখন নাম বদলে হযেছে সিভিল এভিয়েশন হাই স্কুল) পড়তাম। দুই সূত্রেই বিমানবন্দরের সঙ্গে আমার জানাশোনা। বিমানবন্দরের টাওয়ার থেকে শুরু করে সব জায়গাই ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। স্কুল ছিল বিমানবন্দরের কাছে। সিভিল এভিয়েশনের স্টাফ বাসে করে স্কুল টু কুর্মিটোলা সিভিল এভিয়েশন কোয়ার্টার আসাযাওয়া করতাম। বাসগুলো বিমানবন্দরের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতো। যতদূর মনে পড়ে, জায়গাটির নাম ছিল এমটিও। সেখানে যেতে বিমানবন্দরের রানওয়ের একটি অংশ অতিক্রম করতে হতো। আমরা তখন বিনাবাধায় সে জায়গা অতিক্রম করে চলে যেতাম বাসে উঠতে।

আমাদের সেই আটপৌরে বিমানবন্দরটি দেখেই চিয়াং ভাই অবাক হয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন: ‘আহা! কী সুন্দর ও আধুনিক বিমানবন্দর! চীনে যদি এমন একটা বিমানবন্দর থাকতো!’ প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, চিয়াং ভাই আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। কিন্তু পরে বুঝলাম, তিনি সিরিয়াস। তিনি সত্যিই তেমনটি মনে মনে ভেবেছিলেন। আর এর কারণ ছিল, ১৯৭৮ সালে সত্যি সত্যিই বাংলাদেশের তেজগাঁও বিমানবন্দরের (যেটি এখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ব্যবহার করে থাকে) মতো একটি বিমানবন্দর চীনের ছিল না (এখন চীনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমানবন্দরের সংখ্যা ২৪০টিরও বেশি!)।

চিয়াং ভাই একসময় সশস্ত্রবাহিনীতে কাজ করতেন। উচ্চতা ৬ ফুটের কাছাকাছি। সাধারণত সশস্ত্রবাহিনীতে নিয়োগের সময় প্রার্থীর উচ্চতা দেখা হয়। উচ্চতা বেশি না-হলে সশস্ত্রবাহিনীতে জায়গা পাওয়া যায় না। আমার ছোট কাকা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তার কাছে জেনেছি। দেখেও শিখেছি। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের গড় উচ্চতা সবসময়ই বেসামরিক লোকদের তুলনায় বেশি। সুতরাং চিয়াং ভাইয়ের উচ্চতা দেখে আমার অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু আমি শুরুর দিকে অবাক হয়েছি বেসামরিক চীনা নাগরিকদের উচ্চতা দেখে। রাস্তায় বের হলেই দেখি লম্বা লম্বা ছেলেমেয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। আমার উচ্চতা ৫ ফুট ৭। আমার মনে হতে লাগল, অধিকাংশ চীনা ছেলেমেয়েই আমার চেয়ে লম্বা!

আমি চীনাদের উচ্চতা দেখে অবাক হয়েছিলাম পূর্বধারণার কারণে। জাপান-চীন-কোরিয়া বেল্টের লোকজন সাধারণত লম্বা হয় না বলেই আমার ধারণা ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি ব্রুস লি’র ভক্ত। ব্রুস লি’র নিজের উচ্চতাও বেশি ছিল না। ব্রুস লি অভিনীত সিনেমার পাত্র-পাত্রীদের উচ্চতাও তথৈবচ। জাপানি সিরিজ ‘ওসিন’ দেখেছিলাম বাংলাদেশের টিভিতে। যতদূর মনে পড়ে, পাত্রপাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চতায় আমার চেয়ে কম! এসব কারণেই চীনের রাস্তায় লম্বা লম্বা ছেলেমেয়ের আধিক্য দেখে অবাক হয়েছিলাম।

আসলে, একসময় চীনাদের গড় উচ্চতা আজকের তুলনায় অনেক কমই ছিল। ১৯৭৮ সালে যখন চিয়াং ভাই বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, তখন হয়তোবা চীনাদের গড় উচ্চতা বাংলাদেশিদের তুলনায় কম ছিল। এ নিয়ে অবশ্য চিয়াং ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়নি। হতে পারে, নিজে লম্বা হওয়ায় তিনি বাংলাদেশিদের দেখে অবাক হননি! তবে, এটা এখন স্পষ্ট যে, ১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া এবং এর মাধ্যমে অর্জিত উন্নয়নের একটি সুফল হচ্ছে চীনাদের গড় উচ্চতার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এর (Lancet) সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট বলছে, বিগত ৩০ বছর ধরেই চীনাদের গড় উচ্চতা একটু একটু করে বেড়েছে। রিপোর্ট অনুসারে, ১৯ বছর বয়সী চীনা পুরুষদের গড় উচ্চতা ১৭৫.৭ সেন্টিমিটার (আমার চেয়ে অনেক বেশি!)। ফলে, এ বয়সের চীনারা এশিয়ায় উচ্চতার দিক দিয়ে পঞ্চম স্থানে এবং পূর্ব-এশিয়ায় প্রথম স্থানে রয়েছে। এক্ষেত্রে মেয়েদের উচ্চতা অবশ্য খানিকটা কম। তাদের গড় উচ্চতা ১৬৩.৫ সেন্টিমিটার। তবে, এতদঞ্চলে তারাই গড়ে বেশি লম্বা নারী!

সম্প্রতি বিশ্বের ২০০টি দেশ ও অঞ্চলে জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, ১৯৮৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, চীনা পুরুষদের গড় উচ্চতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এক্ষেত্রে চীনা মেয়েদের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। প্রশ্ন হচ্ছে: কেন বিগত তিন বা চার দশক ধরে চীনাদের গড় উচ্চতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনে অর্জিত অভূতপূর্ণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কারণেই এমনটি ঘটেছে। উন্নয়নের ফলে চীনাদের আয় বেড়েছে, বেড়েছে জীবনমান। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে তাদের গড় উচ্চতার ওপর। ল্যানসেট এ নিয়ে কোনো বিশ্লেষণে যায়নি। তবে, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, উন্নয়নের সঙ্গে উচ্চতা বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, চীনে দুধের ভোগ বৃদ্ধি চীনাদের উচ্চতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। দুধে উচ্চমানের ক্যালসিয়াম আছে এটা আমরা সবাই জানি। এই ক্যালসিয়াম হাড়ের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আর হাড়ের বৃদ্ধি মানেই উচ্চতা বৃদ্ধি। চিয়াং ভাইয়ের বাংলাদেশে যাওয়ার বছর তথা ১৯৭৮ সালে গোটা চীনে দুধ উৎপাদিত হয়েছিল মাত্র ৮৮৩,০০০ মেট্রিক টন। তখন দুধ ছিল একটি বিলাসদ্রব্যের মতো। খুব কম মানুষই নিয়মিত দুধ খেতে পেতেন। কিন্তু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চীনে দুধের উৎপাদন ও ভোগও বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে গোটা চীনে দুধ উৎপাদিত হয় ৩০.৭৫ মিলিয়ন (৩ কোটির বেশি) মেট্রিক টন। পাশাপাশি, ডিম, মাংস, তাজা শাকসব্জি ও সামু্দ্রিক খাদ্যের উৎপাদন ও ভোগও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বলা বাহুল্য, বৃদ্ধির এ ধারা এখনও অব্যাহত আছে।

২০১৮ সালে চীনে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের মাথাপিছু বার্ষিক ভোগ ছিল গড়ে ৩৬.২ কেজি। অর্থাৎ সে বছর প্রতিজন চীনা গড়ে ৩৬.২ কেজি করে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খেয়েছেন। তবে, উন্নত দেশগুলোর তুলনায় এটা এখনও অনেক কম। এর মানে চীনাদের গড় উচ্চতা আরও বাড়ার সুযোগ রয়েছে। চীন ২০২০ সালে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয়। কিন্তু এখনও দেশে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার দিক দিয়ে শতভাগ সমতাবিধান করা সম্ভব হয়নি। চীনের সরকার চায়, দেশের প্রতিটি নাগরিক ধনী হবে, তাদের জীবনমান হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। সেই লক্ষ্য অর্জনের পথেই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে দেশটির সরকার ও জনগণ। এই সংগ্রাম থেকে অর্জিত সুফল হয়তো ল্যানসেটের পরবর্তী রিপোর্টে প্রতিফলিত হবে।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com

এইচআর/এমকেএইচ