দেশজুড়ে

পাহাড়সম বাধা পেরিয়ে সফল উদ্যোক্তা

পাহাড়ের নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে মেধা, শ্রম আর দৃঢ় প্রত্যয়ে খুব অল্প বয়সেই পৌঁছে গেছেন সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে। পাহাড়ি বন্ধুর পথ মাড়িয়ে একজন সমাজকর্মী থেকে হয়েছেন 'নারী উদ্যোক্তা'। পেয়েছেন সফল নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতিও। ২০১৩ সালে সাজেকে সাম্পারী রিসোর্ট দিয়ে ব্যবসা শুরু করে চার প্রতিষ্ঠান নিয়ে গড়ে তুলেছেন সাম্পারী গ্রুপ।

গল্পটা পাহাড়ের মেয়ে শাপলা দেবী ত্রিপুরার সমাজকর্মী থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার। ‘সফল উদ্যোক্তা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে রয়েছে নিজের পরিশ্রম, ধৈর্য এবং দৃঢ়চেতা মনোভাব। পদে পদে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে শাপলা দেবী ত্রিপুরাকে। কখনোই দমে যাননি তিনি। দুই হাতে সংসার, স্বামী-সন্তান সামলে নিজের লেখাপড়া আর সামাজিক কর্মকাণ্ড করে গেছেন সমানতালে।

মাটিরাঙ্গা উপজেলার গোমতি ইউনিয়নের পাহাড়ি অজপাড়া গাঁয়ের স্কুলশিক্ষক বাবা নন্দ দুলাল ত্রিপুরা ও মা আলোয়া রানী ত্রিপুরার মেয়ে শাপলা দেবী ত্রিপুরার লেখাপড়ার হাতেখড়ি গোমতির গড়গড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে গোমতি বি কে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হন খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই ১৯৯২ সালে এসএসসি পাস করেন।

এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় শাপলা দেবী ত্রিপুরা ১৯৯২ সালে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে। প্রথম বর্ষে পড়ার সময়ই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় শাপলা ত্রিপুরাকে। একমাত্র ভাই বাবুল ত্রিপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ছোট বোন চামেলী ত্রিপুরা একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে ত্রিপুরা সংস্কৃতি বিকাশে কাজ করছেন।

বিয়ে হওয়ার পর ১৯৯৩ সালে শাশুড়ি-ননদসহ অন্যদের সাথে খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির সভায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। সেখান থেকেই প্রান্তিক নারীদের জন্য কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। শুরু হয় সমাজকর্মী হয়ে ওঠা।

সংসার, স্বামী-সন্তানের পাশাপাশি প্রান্তিক নারীদের উন্নয়ন ও শিক্ষার প্রসারে কাজ করেও নিজের শিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে থাকেননি। ২০১৫ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু ল' ট্যাম্পল কলেজে এলএলবি অধ্যয়নরত।

সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সামাজিক কুসংস্কারসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন শাপলা ত্রিপুরা। অনেককে সাহায্য সহযোগিতা করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েন। তখনই বুঝতে পারেন কারও জন্য কিছু করতে, সমাজের জন্য কিছু করতে গেলে সবার আগে নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। তখনই একজন উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা মাথায় আসে।

২০১৩ সালের শুরুর দিকে সাম্পারী রিসোর্ট দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন সাম্পারী পরিবহন, সাম্পারী এগ্রো ও সাম্পারী ক্রাফটস। বর্তমানে তিনি সাম্পারী গ্রুপ ইনেসিয়েটিভ‘র চেয়ারপারসন।

উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর তিনি 'সাম্পারী চ্যারিটি হোম' প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। ইতোমধ্যে একতলার কাজ শেষ হয়েছে।

দ্বিতল ভবন নির্মাণে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রান্তিক জনপদের অনাথ, অসহায় ও হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা হবে। প্রান্তিক জনপদের ২০ জন মেয়ে নিয়ে শিগগিরই যাত্রা শুরু করবে 'সাম্পারী চ্যারিটি হোম'। যেখান থেকেই শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে প্রান্তিক জনপদের মেয়ে শিক্ষার্থীরা।

বিভিন্ন ব্যবসা থেকে আয়ে প্রান্তিক জনপদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছেন বলেও জানান সফল এ উদ্যোক্তা। ইতোমধ্যে তার আন্তরিক সহযোগিতায় লেখাপড়া শেষ করে একজন প্রশাসন ক্যাডারে, একজন ব্যাংকে এবং অন্য একজন একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। এমন তথ্য দিয়ে যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন খাগড়াছড়ির সবার প্রিয়মমুখ ‘শাপলা দিদি’।

এছাড়া আরও কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কয়েকজন তার বাসায় থেকে খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ আছে।

২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে গুণীজন সংবর্ধনা পেয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে মহিলাবিষয়ক অধিদফতর থেকে 'সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন যে নারী' ক্যাটাগরিতে বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ পুরস্কার লাভ করেন। জয়িতা হিসেবে প্রাপ্ত সম্মানীর অর্থ দান করেন ‘স্বপ্ন প্রতিবন্ধী আশ্রমে’, যা ব্যয় হবে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে।

তিনি বলেন, এসব পুরস্কার আমার কাজের স্বীকৃতি এবং গতি বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি আরও পরিশ্রম করার আগ্রহ সৃষ্টি করেছে- বলেন শাপলা ত্রিপুরা।

খাগড়াছড়ির নিউজিল্যান্ড এলাকার বাসিন্দা লেকি চাকমা বলেন, শাপলা দিদির উৎসাহে আমি আজ আত্মকর্মী। আমি অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখেছি।

অপর আত্মকর্মী বনলতা ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ের অনেক নারীই শাপলা দিদির আলোয় আলোকিত। পিছিয়ে পড়া নারীদের আত্মকর্মী হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রান্তিক জনপদে শিক্ষার আলোকবর্তিকা জ্বেলে চলছেন তিনি।

শাপলা ত্রিপুরা বলেন, স্বাবলম্বী হয়ে বেঁচে থাকার স্বার্থকতাটাই আলাদা। মেয়েদের ব্যবসা করাটাকে আমাদের সমাজ ভালোভাবে নেয় না। এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে ভাঙতে হবে নারীদেরই। তাই বলব, একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হলে আপনাকে অবশ্যই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে হবে। প্রতিবন্ধকতা থাকবেই, তবে ইচ্ছা থাকলে তা ওভারকাম করা সম্ভব। আমি একা বড় হতে চাই না; আশপাশের নারীদেরও সফল দেখতে চাই।

স্বামী কল্লোল রোয়াজা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পে কর্মরত। একমাত্র ছেলে নেলসন ত্রিপুরা মাস্টার্স শেষ করে মায়ের ব্যবসা দেখাশোনা করছেন আর একমাত্র মেয়ে ঐশ্বর্য্য ত্রিপুরা নিনা খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে।

শুরু থেকে প্রতিটি কাজে স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন জানিয়ে শাপলা ত্রিপুরা বলেন, সব সময় তিনি আমার পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন। তার সহযোগিতা ছিল বলেই আমি এতদূর আসতে পেরেছি। একজন সমাজকর্মী থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।

শাপলা দেবী ত্রিপুরাকে পাহাড়ি নারীদের দিশারী উল্লেখ করে খাগড়াছড়ি জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, একজন সমাজকর্মী কীভাবে একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত শাপলা ত্রিপুরা। শাপলা ত্রিপুরা শুধু সমাজকর্মী বা উদ্যোক্তা নন, তিনি পাহাড়ের প্রান্তিক নারীদের আস্থার ঠিকানা।

মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এফএ/জিকেএস