‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা বক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত। তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের জন্য পথের দিশারী।’ কোরআনুল কারিমে আয়াত নাজিল করে কাবা শরিফকে শ্রেষ্ঠত্বের মার্যাদা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। এটি জগতের সর্বপ্রথম ইবাদতেরও ঘর।
খোলাফায়ে রাশেদার পরবর্তী যুগে কাবা শরিফ পুনঃনির্মাণে একরকম প্রতিযোগিতা শুরু হয় বললেই চলে। তা বন্ধে ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ফতোয়া দেন। তার ফতোয়ার ফলেই বন্ধ হয় ভাঙা-গড়ার এই নির্মাণকাজ। কী ফতোয়া দিয়েছিলেন তিনি?
কাবা শরিফ নির্মাণ
হজরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একবার জিজ্ঞাসা করেন যে, জগতের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? উত্তর হলো- মসজিদুল হারাম। আবারো প্রশ্ন করা হলো- এরপর কোনটি? উত্তর হলো- মসজিদে বায়তুল-মুকাদ্দাস। আবার জিজ্ঞাসা করলেন- এই দুটি মসজিদ নির্মাণের মাঝখানে কতদিনের ব্যবধান ছিল? উত্তর হলো- চল্লিশ বছর।’ ([বুখারি, মুসলিম)
কোরআনুল কারিমের বর্ণনা ও হাদিসের আলোকে প্রমাণিত যে, কাবা শরিফ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের হাতেই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। তাই সবচেয়ে প্রামাণ্য সঠিক মত হলো যে, ইবরাহিম আলাইহিস সালামই সর্ব প্রথম কাবা ঘর নিৰ্মাণ করেছিলেন। কারণ এ হাদিসে বায়তুল-মুকাদ্দাস নির্মাণের ব্যবধান বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা বিভিন্ন হাদিস থেকে প্রমাণিত রয়েছে যে, বায়তুল-মুকাদ্দাসের প্রথম নির্মাণও ইবরাহিম আলাইহিস সালামের হাতে কাবা শরিফ নির্মাণের চল্লিশ বছর পর সম্পন্ন হয়। এরপর হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম বায়তুল-মুকাদ্দাসের পুণঃনির্মাণ করেন।
এ ছাড়াও কাবা শরিফ নির্মাণে আরও তথ্য-
হজরত আদম আলাইহিস সালম সর্ব প্রথম কাবা শরিফ নির্মাণ করেছেন। আবার কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক নির্মিত এ কাবা ঘর হজরত নুহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবন পর্যন্ত অক্ষত ছিল। মহাপ্লাবনে এ ঘর বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এরপর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রাচীন ভিত্তির উপর এ ঘর পুনঃনির্মাণ করেন। তবে উল্লেখিত বর্ণনা দুটির কোনটিই সঠিক সনদে প্রমাণিত হয়নি। বরং কাবা ঘরের প্রথম নির্মাণকারী বলতে পারি।
কাবা ঘরের নির্মাণ সম্পর্কে আরও যা জানা যায়
পরবর্তীতে এক দুর্ঘটনায় কাবা ঘরের প্রাচীর ধ্বসে গেলে জুরহাম গোত্রের লোকেরা একে পুনঃনির্মাণ করেন। এভাবে কয়েক বার বিধ্বস্ত হওয়ার পর একবার আমালেকা সম্প্রদায় ও একবার কুরাইশরা এ ঘর নিৰ্মাণ করেন। সর্বশেষ এ ঘর নির্মাণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও শরিক ছিলেন এবং তিনি নিজ হাতে ‘হাজরে-আসওয়াদ' স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু কুরাইশদের এ নির্মাণের ফলে ইবরাহিমি ভিত্তি সামান্য পরিবর্তন হয়ে যায়। তাহলো-
প্রথমত : কাবার একটি অংশ হাতিম কাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত : ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নির্মাণে কাবা ঘরের দরজা ছিল দুটি। একটি প্রবেশের জন্য এবং অপরটি বের হওয়ার জন্য। কিন্তু কুরাইশরা শুধু পূর্বদিকে একটি দরজা রাখে।
তৃতীয়ত : তারা সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে- যাতে সবাই সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে; বরং তারা যাকে অনুমতি দেবে সেই যেন প্রবেশ করতে পারে। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলেছিলেন, ‘আমার ইচ্ছা হয়, কাবা ঘরের বর্তমান নির্মাণ ভেঙ্গে দিয়ে ইবরাহিমি নির্মাণের অনুরূপ করে দেই। কিন্তু কাবা ঘর ভেঙ্গে দিলে নও-মুসলিম অজ্ঞ লোকদের মনে ভুল বুঝাবুঝি দেখা দেওয়ার আশংকার কথা চিন্তা করেই বর্তমান অবস্থা বহাল রাখছি।’ (বুখারি, মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে জোবায়ের কর্তৃক কাবা ঘর নির্মাণ
কাবা শরিফ নিয়ে এ কথাবার্তার কিছুদিন পরই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। কিন্তু হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ভাগ্নে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জোবায়ের প্রিয় নবির ইচ্ছার বিষয়টি অবগত ছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদীনের পর যখন মক্কার উপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি উপরোক্ত ইচ্ছাটি কার্যে পরিণত করেন এবং কাবা ঘরের নির্মাণ ইবরাহিমি নির্মাণের অনুরূপ করে দেন। কিন্তু মক্কার উপর তার কর্তৃত্ব বেশি দিন টেকেনি।
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কর্তৃক কাবা ঘর সংস্কার
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ মক্কায় সৈন্যাভিযান করে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জোবায়ের তাকে শহীদ করে দেন। সে কাবা ঘরকে আবার ভেঙ্গে জাহেলিয়াত আমলে কুরাইশরা যেভাবে নির্মাণ করেছিল, সেভাবেই নির্মাণ করেন।
বারবার কাবা ঘর পুননির্মান বন্ধে ফতোয়া
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পর কোনো কোনো বাদশাহ উল্লেখিত হাদিস দৃষ্টে কাবা ঘরকে ভেঙে হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী নির্মাণ করার ইচ্ছা করেন। আর ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহিমাহুল্লাহর কাছে এ বিষয়ে ফতোয়া চান।
ইমাম মালেকের ফতোয়া
তখন তিনি ফতোয়া দেন যে- এভাবে কাবা ঘর ভাঙ্গা-গড়া অব্যাহত থাকলে পরবর্তী বাদশাহদের জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে যাবে এবং কাবা ঘর তাদের হাতে একটি খেলনায় পরিণত হবে। কাজেই বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, সে অবস্থায়ই থাকতে দেয়া উচিৎ। সমগ্র মুসলিম জাহান ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহিমাহুল্লাহর এ ফতোয়া গ্রহণ করে নেয়।
ফলে আজ পর্যন্ত হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নির্মাণই অবশিষ্ট রয়েছে। তবে মেরামতের প্রয়োজনে ছোটখাটো কাজ সব সময়ই অব্যাহত থাকে। বর্তমান আমলে বেশ কয়েক বছর আগেও সাবেক খাদেমুল হারামইন এক সংস্কার কাজ করে কাবা শরিফের সৌন্দর্য বহুগুণ বর্ধিত করেন।
এমএমএস/জেআইএম