খেলাধুলা

ধীরে ধীরে বাড়ছে রাগবির বিস্তৃতি, বড় সংকট মাঠের

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) থেকে বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশন। মাঝে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন আরও ৫১টি। দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের তালিকাটা বেশ লম্বাই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখন দেশের সবচেয়ে ধনী ফেডারেশন। এরপরই ফুটবল।

বাকি ফেডারেশনগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই বছর চলে নানা সংকট আর কষ্টে। অর্থ সংকট, ভেন্যু সংকটের মধ্যেই চলে তাদের কার্যক্রম। ছোট এই ফেডারেশনগুলোর ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা।

ছোট ছোট ফেডারেশনগুলো কিভাবে তাদের কার্যক্রম চালায় তা নিয়েই জাগোনিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজকের খেলা রাগবি।

রাগবি খেলাটির নাম শুনলেই যে কেউ মনে করবে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা স্কটল্যান্ডের খেলা এটি। যুক্তরাষ্ট্রেও বেশ জনপ্রিয়। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে রাগবি খেলাটা জনপ্রিয় জাপানে। ফুটবলের দেশ হিসেবে পরিচিত আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ের মত দেশগুলোতেও রাগবি সমান জনপ্রিয়।

ওয়ার্ল্ড সকার বলতেই দুটি খেলাকে বোঝানো হয়- একটি ফুটবল, অন্যটি রাগবি। বাংলাদেশের এই খেলার প্রচলন নেই বললেই চলে। খেলাধুলার সাথে সংশ্লিষ্টরা ছাড়া এ দেশের সাধারণ মানুষ রাগবি খেলার সঙ্গে পরিচিত নন। তবে, ২০০৬ সাল থেকে এই খেলাটি বাংলাদেশেও প্রচলিত হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে এই খেলা এখন বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান অনেকদুর বিস্তৃত করে নিতে পেরেছে।

দেশের মাটিতে অপ্রচলিত খেলাটিকে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য যিনি নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তিনি হলেন মৌসুম আলী। বাংলাদেশ রাগবী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশে রাগবি আলোচনায় আসে মূলতঃ ২০০৬ সালে অ্যাসোসিয়েশন গঠণের মধ্যে দিয়ে। হ্যান্ডবলের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত মৌসুম আলীর উদ্যোগে ওই বছর গঠন হয় বাংলাদেশ রাগবি অ্যাসোসিয়েশন। প্রতিষ্ঠলগ্ন থেকে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাল করে আসছেন তিনি।

পরে বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন (ইউনিয়ন) নামে এই ক্রীড়া ফেডারেশনটি দেশে রাগবির প্রচলন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। দেশে যে কয়টি ফেডারেশনকে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় তার মধ্যে রাগবি অন্যতম।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন (ইউনিয়ন) পরিচালিত হয়ে আসছে অ্যাডহক কমিটি দিয়ে। বেশ কয়েকবার কমিটির সভাপতি বদল হয়েছে। বর্তমান সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ২০১৯ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

ছোট ফেডারেশন হলেও এই খেলাটির কিছু না কিছু আয়োজন থাকে বছরজুড়ে। খেলাধুলার পাশাপাশি সামাজিক কিছু কাজও করে আসছে ফেডারেশনটি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশনকে বছরে অনুদান দেয় ২ লাখ টাকা। তবে তৃণমূল ট্রেনিংয়ের জন্য ক্রীড়া প্রশাসন থেকে তারা বরাদ্দ পায়। সব কিছু মিলয়ে রাগবি ফেডারেশনের বছরে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকার কার্যক্রম হয়ে থাকে।

ঘরোয়াভাবে আয়োজনগুলো ছাড়াও রাগবি দল যখন বিদেশে কোনো টুর্নামেন্ট খেলতে যায়, তখন আরো বেশি ব্যয় হয় বলে জানালেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। অনুদান ও স্পন্সর থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে তারা পুরো কার্যক্রম শেষ করতে পারে না।

বছরে লাখ দশেক টাকা তাদের ঘাটতি রয়ে যায়। তবে ঘাটতি প্রায় কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে ফেডারেশন। এই যেমন সর্বশেষ চার বছরে তাদের তেমন ঘাটতি ছিল না বলে জানালেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মৌসুম আলী।

কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রায় নিয়মিতই রাগবির বিভিন্ন কর্মসূচিতে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। এর মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ওয়ালটন, ডায়মন্ড মেলামাইন ও মনোয়ারা হাসপাতাল।

ছেলে ও মেয়েদের নিয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়মিতই আয়োজন হয়ে থাকে রাগবিতে। এর বাইরে স্কুল টুর্নামেন্ট, কলেজ টুর্নামেন্ট, কিডস লিগ, জাতীয় ক্লাব কাপ চ্যাম্পিয়নশিপ, স্বাধীনতা দিবস রাগবি, বিজয় দিবস রাগবি, বৈশাখী রাগবি, সেন্ট রাগবি, পথকলি রাগবি, মাদকাসক্ত রাগবি এবং করোনার সময়ে দুটি করোনা কাপও আয়োজন করেছে রাগবি ফেডারেশন।

দেশে নতুন এই খেলায় তরুণ প্রতিভা খুঁজে বের করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে ফেডারেশন। গত বছর করোনার মধ্যেও ৩৫ জেলা প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি করেছিল ফেডারেশন।

কতটা ব্যয়বহুল এই রাগবি খেলা? ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মৌসুম আলী জানালেন, ‘রাগবি খেলা মোটেও ব্যয়বহুল নয়। বল হলেই চলে। পরিপাটি মাঠেরও দরকার নেই। যে কোন পরিবেশে এবং যে কোন সময় রাগবি খেলা যায়।’

রাগবিতে এক দলে খেলোয়াড় থাকেন ২৩ জন। মাঠে নামে ১৫ জন করে। তারপরও বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন (ইউনিয়ন) মাঠ সংকটে ভুগছে। যাযাবরের মতো রাগবি খেলোয়াড়রা একেক দিন একেক মাঠে খেলে থাকেন।

মাঠ পেলেও দেখা গেলো সেখানে বারপোস্ট লাগানো যায় না। পল্টন ময়দান ও মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজ মাঠে ছেলেদের খেলা হয়ে থাকে। মেয়েরা খেলে ধানমন্ডি সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের মাঠে।

ভেন্যু সংকট থাকলেও ফেডারেশন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে কোন ভেন্যু নিজেদের জন্য চায়নি। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সাধারণ সম্পদক মৌসুম আলী বলেছেন,‘আমাদের আসলে নিজেদের করে ভেন্যুও দরকার নেই। কষ্ট হলেও আমরা তো যে কোন মাঠেই খেলতে পারি।’

রাগবিতে ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পা রেখেছে। এশিয়া কাপের ‘বি’ গ্রেডে বাংলাদেশ নিয়মিতই অংশ নিয়ে থাকে। ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরের এশিয়া কাপের ‘বি’ গ্রেডের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ব্রুনাই ও লাসকে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এখন বাংলাদেশ সহসাই হারাতে পারে নেপাল, সিরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই ও লাওসের মতো দলগুলোকে।

বাংলাদেশ এশিয়া রাগবির সদস্য। কর্মকান্ডের দিক দিয়ে বাংলাদেশ আছে ৬ নম্বরে। আর বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫ এর মধ্যে। দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন (ইউনিয়ন) নিজেরা কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারেনি। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে নেপালকে নিয়ে একটি সিরিজ আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে সেটা আয়োজন করতে পারেনি।

তবে ফেডারেশন এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু কাপ আয়োজনে। বাংলাদেশ, নেপাল, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, সিরিয়া, ভুটান ও মালদ্বীপকে এই টুর্নামেন্টে খেলানোর চেষ্টা করবে ফেডারেশন। সাধারণ সম্পাদক মৌসুম আলী জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু কাপের জন্য তাদের স্পন্সর ঠিক হয়ে আছে।

রাগবির যে জাতীয় দল আছে সে দলটি নিয়মিতই অনুশীলন করে। কারণ, জাতীয় দলের ৯৫ ভাগ খেলোয়াড়ই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অভিষেক হয়েছিল ২০১৫ সালে। সেবার ভারতের চেন্নাইয়ে অভিষেক ম্যাচে নেপালকে হারিয়েছিল বাংলাদেশের ছেলেরা। ২০১৯ সালে কাতারে এশিয়া কাপ কোয়ালিফাইং রাউন্ডে নেপালকে হারিয়ে রানার্সআপ হয়েছিল বাংলাদেশ।

জাতীয় দলের জন্য স্থানীয় কোচ আছেন ৫ জন। তারাই মূলতঃ সেনাবাহিনীর যে খেলোয়াড়রা জাতীয় দলে আছেন তাদের অনুশীলন করান। মাহফুজুল ইসলাম কামরুল নামের এক বাংলাদেশি সাউথ এশিয়ান রাগবির ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। শোভন নামের আরেকজন আছেন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট কমিটির সদস্য হিসেবে।

অনেক ফেডারেশনের যেমন টাকার অভাবে মাঝেমধ্যে খেলা আয়োজন সম্ভব হয় না, রাগবিতে সে রকম নয়। সাধারণ সম্পাদক জানালেন, আমাদের অর্থের তেমন অভাব নেই। কর্মসূচি দিলে সেটা আয়োজন হয়েই যায়।

দেশের সব জেলায় এখনো রাগবির প্রচলন হয়নি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নড়াইলে রাগবির চর্চা ভালো। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ২০ জেলা দল অংশ নিয়ে থাকে। ক্লাব আছে ঢাকায় ২০টির মতো, বিভিন্ন জেলায় আছে ৩৫টি। অনেক দেশে রাগবির লিগ নিয়মিত হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশ এখনো লিগ আয়োজন করতে পারেনি। কারণ, লিগের জন্য দরকার এক মাসের বেশি সময়ের জন্য মাঠ। সেটা একটা বড় সমস্যা।

ছেলেদের মতো মেয়েদের রাগবিও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০১৮ সালে নারী দল ভারতের উড়িষ্যায় এশিয়ান ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে এসেছে। পরের বছর ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান নারী চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলেছে। সেখানে তাইওয়ানের বিপক্ষে ড্র করেছে। নারী দলের এটিই আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ সাফল্য।

রাগবির জন্য সবচেয়ে ভাল খবর হলো জাতীয় স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড কারিকুলামে খেলাটিকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এরপরই ফেডারেশন দেশব্যাপী প্রতিভা অন্বেষণের জন্য টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিল। যার অংশ হিসেবে ৭ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আয়োজন করেছিল এই প্রতিযোগিতা।

বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশাবাদী, জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডেও কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত হওয়াটা আমাদের জন্য বিশাল এক অর্জন। এখন দেশব্যাপী শিক্ষার্থীরা এ খেলাটি সম্পর্কে ধারণা পাবে এবং খেলাটির প্রসার হবে।

আরআই/আইএইচএস/