এক দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অসংখ্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে আটটি জাতির নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। মায়ের ভাষায় শিক্ষা লাভ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। সেই দাবি অনুসারে ২০১৭ সাল থেকে স্ব স্ব মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে পাহাড়ের তিনটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা। বাংলা, ইংরেজি মাধ্যমের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মায়ের ভাষায়ও পড়তে পারছে তারা।
২০১৭ সাল থেকে মাতৃভাষায় ছাপানো বই পাচ্ছে খাগড়াছড়িসহ পাহাড়ের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা, যা সরবরাহ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় পাঠদানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। ফলে উদ্যোগেই আটকে আছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে ২০১৭ সালে স্ব-স্ব মাতৃভাষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হলেও শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় সেভাবে আলোর মুখ দেখেনি এ কার্যক্রম। চলতি বছরের প্রথম দিনেই খাগড়াছড়িতে প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে স্ব-স্ব মাতৃভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়া হয়। মায়ের ভাষায় বর্ণমালার বই-খাতা পেয়ে উচ্ছ্বসিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এসব শিক্ষার্থীরা।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ শিক্ষাবর্ষে জেলায় ৩৮ হাজার ৫১৭ জন চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিক্ষার্থীর মাঝে ৮৫ হাজার ৭৫৪ শিক্ষার্থীকে স্ব-স্ব মাতৃভাষায় রচিত বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিতে আমার বই ও এসো লিখতে শিখি খাতা, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে দেওয়া হয়েছে মাতৃভাষায় রচিত বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বই। অন্যদিকে মাতৃভাষায় রচিত বাংলা বই দেওয়া হয়েছে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের।
নানা সঙ্কটেও পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা মায়ের ভাষায় পড়ছে জানিয়ে খাগড়াছড়ির সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, জাবারাং কল্যাণ সমিতি নিজেদের উদ্যোগে স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রেও প্রতিটি স্কুলে এক বা দুইজনের বেশি শিক্ষকের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। যেখানে যে সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি সেখানে সে সম্প্রদায়ের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
মাতৃভাষায় পাঠদান তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হলেও শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরকারের এ উদ্যোগটির কোনো সুফল পাচ্ছে না ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। এমনটাই মনে করছেন পাহাড়ের সচেতন নাগরিক সমাজ। তাদের মতে প্রশিক্ষিত শিক্ষক সঙ্কটের ফলে এ শিক্ষা কার্যক্রম শিশুদের জন্য বোঝা হতে পারে।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক সঙ্কটের কথা জানিয়ে গুইমারার শ্বশানটিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, শিক্ষকদের সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে স্ব স্ব মাতৃভাষায় পাঠদান শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে মাটিরাঙ্গার গকুলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদ পারভেজ বলেন, মাতৃভাষায় পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত শিক্ষক সঙ্কট নিরসন করা না হলে পাঠদানে বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যাবে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) সমাবেশ চাকমা বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকাংশ শিক্ষক স্ব স্ব মাতৃভাষা বলতে পারলেও মাতৃভাষার বর্ণমালার ওপর তেমন দক্ষতা নেই। তাই মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিত করতে যে বিদ্যালয় এলাকায় যে সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে সে এলাকায় ওই সম্প্রদায়ের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই স্ব স্ব মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিত হবে।
ত্রিপুরা ভাষা (ককরবক ভাষা) কমিটির সদস্য ও মাতৃভাষায় শিক্ষাক্রম চালুর অন্যতম উদ্যোক্তা এবং জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, প্রাথমিক স্তরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্ব স্ব মাতৃভাষায় পাঠদানের উদ্যোগ সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ। সরকারি উদ্যোগে শিশুরা মাতৃভাষায় ছাপানো বই পাচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে (ডিপিএড) মাতৃভাষার প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ না থাকায় মাতৃভাষায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
জাবারাং কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করার কথা জানিয়ে মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, স্ব-স্ব মাতৃভাষার পাঠদান নিশ্চিত করতে পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।
পিটিআই বা উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে স্ব স্ব মাতৃভাষার ওপর পাঠদানে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
এদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন পাড়া কেন্দ্রে শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান করানো হচ্ছে। টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় ৩ থেকে ৫ বছরের শিশুদের মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলাও পড়ানো হয়। যাতে প্রাথমিকের পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারে শিক্ষার্থীরা।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে স্বল্প পরিসরে এ কার্যক্রম শুরু হলেও তা বৃহৎ আকারে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইউনিসেফ‘র সহায়তায় সরকারি অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পাড়া কেন্দ্রে ২১ হাজার ৭৯০ জন শিশু মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করছে। তিন পার্বত্য জেলায় এ সংখ্যা ৬১ হাজারের ওপরে।
খাগড়াছড়ি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের ভাইবোনছড়া মারমা পাড়া কেন্দ্রের কর্মী আনুচিং মারমা ও মাঠ সংগঠক লিলিপ্রু মারমা বলেন, বাংলার পাশাপাশি পাড়া কেন্দ্রে শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান করানো হয়। ফলে তারা মাতৃভাষা সম্পর্কে জানতে পারে। মাতৃভাষায় পাঠদানের কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের বর্ণমালা চিনতে, লিখতে ও বলতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের খাগড়াছড়ি জেলা প্রকল্প ব্যবস্থাপক মতিউর রহমান বলেন, পাড়া কেন্দ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের শিশুদের বাতিঘর। এ কেন্দ্রের মাধ্যমে মাতৃভাষার পাশাপাশি পড়ানো হচ্ছে বাংলাও। মাতৃভাষায় পাঠদানের ফলে ওরা খুব সহজেই আত্মস্থ করতে পারছে। এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার কমেছে।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এফএ/জেআইএম