১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাত। রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গোলাবর্ষণ শুরু করে পুলিশ লাইন্স ঘিরে। ভিতরে তখন আটকা বাঙালি পুলিশ সদস্যরা। আধুনিক সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের হাতিয়ার পুরোনো বন্দুক বা থ্রি নট থ্রি রাইফেল। তৎকালীন আইজিপির দেহরক্ষী কনস্টেবল আব্দুল আলীর পাগলা ঘণ্টা ধ্বনিতে তা নিয়েই গর্জে উঠলেন বীর পুলিশ সদস্যরা। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপক্ষে প্রাণপণ লড়াই চললো কয়েক ঘণ্টা। সেই রাতে শহীদ হলেন কমপক্ষে দেড়শ বাঙালি পুলিশ সদস্য।
সেই যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নসহ দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের বীরত্বের স্মৃতিগাথা তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। স্মৃতিস্তম্ভের পাশে দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত এ জাদুঘরে আছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদানের নানান স্মারক।
২০০৯ সালে তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদ (বর্তমানে এমপি) ও ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার একেএম শহীদুল হকের (সাবেক আইজিপি) সঙ্গে পরামর্শ করে পুলিশের তৎকালীন ডিসি মো. হাবিবুর রহমান (বর্তমানে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি) জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। মিলিটারি একাডেমি পরিদর্শন করে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগও নেন মো. হাবিবুর রহমান। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের টেলিকম ভবনে দুটি রুম নিয়ে প্রথম পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়।
স্থাপনার দিক থেকেও নান্দনিক এ জাদুঘরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। গ্যালারির দুই পাশের দেয়ালে আছে বঙ্গবন্ধুর নানা সময়ের দুর্লভ সব আলোকচিত্র। পাশেই মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা প্রায় দুই হাজার বইয়ের সমন্বয়ে এক মনোরম লাইব্রেরি। যে কেউ মনোরম পরিবেশে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তে পারবেন। এছাড়া এখানে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান বিষয়ে লেখা বিভিন্ন বই কেনারও ব্যবস্থা রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু গ্যালারির ঠিক মাঝ বরাবর গোলাকার দুটি সিঁড়ি নেমে গেছে জাদুঘরের মূল কক্ষে। জাদুঘরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশাল সংগ্রহশালা। যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুলিশ বাহিনীর নানান স্মৃতিচিহ্ন, অস্ত্র, পোশাক, দলিল-দস্তাবেজ। এমনকি বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহার করা রিভলবারটিও সংরক্ষিত আছে এ জাদুঘরে।
দর্শনার্থীরা গেলেই জাদুঘরে দেখতে পাবেন- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত পোশাক, চশমা, টুপি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম লেটার, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি আবদুল খালেকের ব্যবহৃত চেয়ার, যুদ্ধের সময় উদ্ধার করা গুলি ও মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হ্যান্ডমাইক, যুদ্ধের সময় দূর থেকে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য পুলিশ বাহিনীর সার্চ লাইট, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের টেলিকম ভবনের দেয়াল ঘড়ি, যুদ্ধকালীন পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন চিঠিপত্র, ২৫ মার্চ রাতে সারাদেশে পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগ আক্রমণের খবর দেওয়া হেলিকপ্টার ব্যাজ, বেতার যন্ত্র, ওয়্যারলেস সেট, পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেঞ্চ ও প্রথম প্রতিরোধের রাতে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করা পাগলা ঘণ্টাসহ শত শত ঐতিহাসিক নিদর্শন।
এ জাদুঘরে আরও আছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ব্যবহার করা ৭.৬২ এমএম রাইফেল, রিভলবার, ২ ইঞ্চি মর্টার এবং মর্টারশেল, ৩০৩ এলএমজি, মেশিনগান, ৭.৬২ এমএম, এলএমজি .৩২ বোর রিভলবার, .৩৮ বোর রিভলবার, ১২ বোর শর্টগান ও ৯ এমএম এমএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্রের সমাহার।
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের একজন ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, একজন ডিএসপি, একজন এসডিপিও, ১২ জন পুলিশ পরিদর্শক, ৮১ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শকসহ ৭৫১ জন পুলিশ শহীদ হন। এদের মধ্যে রয়েছেন- তৎকালীন রাজশাহীর ডিআইজি মামুন মাহমুদ, রাজশাহীর পুলিশ সুপার শাহ আবদুল মজিদ, কুমিল্লার পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এম শামসুল হক, পিরোজপুর মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা (এসডিপিও) এবং কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও ডক্টর জাফর ইকবালের বাবা ফয়েজুর রহমান আহমেদসহ অনেকে।
পুলিশে পাঁচজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাদের মধ্যে তিনজন বীরবিক্রম ও দুইজন বীর প্রতীক।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ও পুলিশ মুক্তযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রায় হাজারখানেক বই রয়েছে লাইব্রেরিতে। অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা যায়। এছাড়া জাদুঘরে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত পোশাক, চশমা, টুপি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম লেটারসহ শত শত ঐতিহাসিক নিদর্শন।
তিনি বলেন, দর্শনার্থীরা মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান জানার পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর সংগ্রাম ও সাফল্যের ইতিহাসও জানতে পারবে।
জানা যায়, দর্শনার্থীরা ১০ টাকার টিকেটের বিনিময়ে জাদুঘরটি পরিদর্শন করতে পারবেন। গ্রীষ্মকালে (মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং শীতকালে (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। তবে ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের জন্য এবং সব জাতীয় দিবসে সবার জন্য বিনামূল্যে জাদুঘর ঘুরে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। সাপ্তাহিক বন্ধ বুধবার ছাড়া শুক্রবারও বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে।
টিটি/এএ/এমএস