দেশজুড়ে

মেডিকেলে সুযোগ পাওয়া মেয়ের খরচ যোগাতে চিন্তায় ভ্যানচালক বাবা

অভাবের পোড় খাওয়া চোখে নিরন্তর স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসেন ভ্যানচালক আফতাবর রহমান। তাইতো ভ্যান চালিয়ে দুই সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

নিরন্তর চেষ্টায় তিনি অনেকটাই সফল। একমাত্র ছেলে মুন্না আলী বাংলা বিষয় নিয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেয়ে আলপনা আক্তার এবার মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ হয়েছে তার।

বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে পাত্রস্থ করেছেন আর ছোট মেয়ে পড়ছে উচ্চ মাধ্যমিকে। ৩ মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে আফতাবর রহমানের পরিবারে এই খবরগুলো অনেক আনন্দের হলেও ছেলের পাশাপাশি এবার মেয়ের মেডিকেলে পড়ানোর খরচের চিন্তা কপালে ভাঁজ ফেলছে এই তার।

আফতাবর রহমানের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের ধারিয়া বেলসাড়া গ্রামে। ভিটেমাটি আর ভ্যান ছাড়া কোনো সম্পদ নেই তার।

বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) সকালে তার ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন দিয়ে জানা গেলো তিনি ভ্যান নিয়ে বের হয়েছেন। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের কুশলডাঙ্গী বাজারে তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানালেন দুই সন্তানকে এতদূর নিয়ে আসার গল্প।

আফতাবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ভ্যান চালিয়ে ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মেয়ে দুটোকে পড়াচ্ছি। ছেলে মুন্না আলীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ২৫ শতক আবাদী জমির মধ্যে ৫ শতক জমি বিক্রি করেছি। পরবর্তীতে তার পড়ালেখার খরচ যোগাতে গিয়ে অবশিষ্ট ২০ শতক জমিও বিক্রি করতে হয়েছে। এছাড়াও প্রতিমাসে ৩-৪ হাজার টাকা ছেলেকে ঢাকায় পাঠানো, অন্য দুই মেয়ের পড়ালেখার খরচ এবং সাংসারিক ব্যয় বহনের একমাত্র মাধ্যম তার ভ্যানটি। একদিন ভ্যান নিয়ে না বের হলেই সংসার খরচে টান পড়ে।

তিনি আরও জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে দুই সন্তান পড়াশোনার সময় ডাচবাংলা ব্যাংক থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছিল। এ শিক্ষাবৃত্তির টাকা তার পরিবারের কষ্ট অনেকটাই লাঘব করেছে। মেয়েকে ভর্তি করানোর টাকা যোগাড় করতে বুধবার থেকেই তিনি তার নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলছেন। তারা আশ্বাস দিয়েছেন ভর্তির টাকা যোগাড় করে দেওয়ার।

কিন্তু তার চিন্তা পরবর্তী খরচ নির্বাহ নিয়ে। আগের দিনগুলোতে ভ্যান চালিয়ে আয় বেশি হলেও থ্রি-হুইলার ও অটোচার্জারের ভিড়ে ভ্যানের যাত্রী পাওয়া দুষ্কর। আবার বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে।

আফতাবর রহমানের স্ত্রী মাজেদা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের রক্তের শেষবিন্দু থাকা পর্যন্ত সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাবো। মানবিক কারণে যদি কেউ সহযোগিতার হাত বাড়াতে চান, তাহলে আমরা সহযোগিতা নেবো।

সদ্য ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থী আলপনা আক্তার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কুশডাঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলে কুশলডাঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং সমিরউদ্দিন স্মৃতি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

ভ্যানচালক বাবার স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা জানিয়ে শিক্ষার্থী আলপনা আক্তার বলেন, বাবা অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করাচ্ছেন। চিকিৎসক হয়ে বাবা, মাসহ অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবো। বাবার স্বপ্নপূরণে সকলের কাছে দোয়া চান তিনি।

সমিরউদ্দিন স্মৃতি মহ্যাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বেলাল রব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, সমাজে এখনও অনেক অভিভাবক মেয়েদের বোঝা মনে করেন। সামর্থ্য থাকার পরও পড়ালেখা না করিয়ে বিয়ে দিয়ে দায়ভার থেকে মুক্তি নেন। অনেক শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়। এমন একটা পরিবেশের মধ্যেও ভ্যানচালক বাবা তার দুই সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন, যা বাস্তব হতে চলেছে। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়ার। এমন বাবার আদর্শ ধারণ করা উচিত সকল বাবাদের।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, চাইলে ওই ভ্যানচালক বাবার সন্তানদের পড়ালেখার ব্যয় বহনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।

এফএ/এএসএম