দীর্ঘদিন ধরে নির্বাসিত বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। ১৯৯৪ সালে দেশ ত্যাগের পর তিনি বর্তমানে ভারতে বসবাস করছেন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তসলিমা নাসরিন বেশ সরব।
নির্বাসিত এই লেখিকার জন্মস্থান ময়মনসিংহের নান্দাইলে। তবে মা-বাবার সঙ্গে ময়মনসিংহ নগরীর আমলাপাড়ার বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি। সেই বাড়িটির নাম ছিল ‘অবকাশ’। এই বাড়িতেই কেটেছে তসলিমা নাসরিনের শৈশব-কৈশোর আর যৌবন।
সম্প্রতি তসলিমা নাসরিন ফেসবুকে একটি ভিডিও শেয়ার দিয়ে তার ময়মনসিংহের অবকাশ নামে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে বলে দাবি করেন।
ওই পোস্টে তিনি লেখেন, কেউ কেউ ফেসবুকে অবকাশ ভাঙার ছবি পোস্ট করছে, দুঃখ করছে, স্মৃতিচারণ করছে। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সেই অবকাশ। ময়মনসিংহ শহরের টিএন রায় রোডে আমার বাবার কেনা সুন্দর বাড়িটি অবকাশ। এই অবকাশ ভেঙে গুঁড়ো করার সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছে তাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই, আমার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু এইটুকু জানি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব লোভী, স্বার্থপর, ধুরন্ধর, কেউ কেউ কট্টর মৌলবাদী। সবারই আমি চক্ষুশূল। এককালে শহরের সাহিত্য-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রগতিশীলতার একটি কেন্দ্র ছিল যে বাড়িটি, আজ সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত। ধন-দৌলতের কাঙালদের কাছে প্রগতিশীলতা, উদারতা সহমর্মিতা, স্মৃতি ও সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই। শুনেছি বাড়িটিতে আমার মায়ের হাতের লাগানো সব ফল-ফুল গাছ শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে একটি আধুনিক বহুতল বিল্ডিং বানানো হচ্ছে। আমার কর্মঠ বাবার অকর্মণ্য উত্তরসূরিরা সেই বিল্ডিংয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বংশ পরম্পরায় খাবে।
তসলিমা নাসরিন আরও লেখেন, ও বাড়ির এখন আমি কেউ নই। আমি তো তিরিশ বছর ব্রাত্যই। ইট পাথরে, চুন-সুরকিতে, কাঠে-কংক্রিটে স্মৃতি থাকে না, স্মৃতি থাকে মনে। অবকাশ রইলো আমার মনে। যে বাড়িটিতে বসে আমি প্রথম কবিতা লিখেছি, প্রথম কবিতা-পত্রিকা ছাপিয়েছি, প্রথম কবিতার বই লিখেছি, নির্বাচিত কলাম লিখেছি, যে বাড়িটির মাঠে প্রথম গোল্লাছুট খেলেছি, যে বাড়িটির ছাদে প্রথম পুতুল খেলেছি, যে বাড়িটির ভেতর প্রথম রবীন্দ্রনাথ আওড়েছি, উঠোনজুড়ে নেচে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ করেছি, যে বাড়িটিতে দাদা বেহালা বাজাতো, ছোটদা গিটার বাজাতো, বোন গান গাইতো, মা আবৃত্তি করতো, বাবা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতো, যে বাড়িটিতে বসে প্রথম প্রেমের চিঠি লিখেছি, যে বাড়িটিতে আমি একই সঙ্গে সংবেদনশীল এবং সচেতন মানুষ হয়ে উঠেছি, সে বাড়িটি রইলো আমার মনে। কোনো হাতুড়ি শাবল কুড়ালের শক্তি নেই সে বাড়িটি ভাঙে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তসলিমা নাসরিনের শৈশব-কৈশোর কাটা বাড়িটির নাম অবকাশ। তার বাবার নাম রজব আলী। তিনি পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। তসলিমা নাসরিনরা দুই বোন ও দুই ভাই। তারা নগরীর আমলাপাড়ার ওই অবকাশ বাড়িটিতেই বসবাস করতেন।
বাবা রজব আলীর মৃত্যুর পর দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ওই বাড়িটি চার ভাগ হয়। সম্প্রতি তসলিমা নাসরিনের এক ভাই তার ভাগের প্রায় ৯ শতাংশ জমি ‘বিএসআই ডেভেলপার’র কাছে বিক্রি করে দেন। কেনার পর গত ১০ থেকে ১২ দিন ধরে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ওই বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে। বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হওয়ার পরই মূলত বিষয়টি আলোচনায় আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বিএসআই ডেভেলপার’র পার্টনার রাসেল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যে জায়গা নিয়েছি, ওই জায়গার সঙ্গে তসলিমা নাসরিনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কারণ আমরা তার ভাইয়ের কাছ থেকে তার ভাইয়ের অংশ রেজিস্ট্রি করে কিনে নিয়েছি। আমরা বৈধ কাগজপত্র দেখেই জমি কিনেছি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে তসলিমা নাসরিনের ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাগো নিউজ। তবে পরিবারের কারও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, আমার বাবা-চাচা দুই ভাই ও দুই বোন ছিলেন। বাবা-চাচা দুজনই মারা গেছেন। আমার দাদার মৃত্যুর পর বাড়িটি দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দুই ভাই ও দুই বোনের নামে ভাগ হয়। আমার বাবার ভাগের ৯ শতাংশের চেয়ে কিছু কম অংশ আমরা বিক্রি করেছি। বাড়ির সেই অংশটুকু ভেঙে বহুতল ভবন হচ্ছে। অন্য তিনজনের বাড়ি ও জমি অক্ষত অবস্থায়ই আছে। তসলিমা নাসরিনের বাড়ির অংশের একটি ইট পর্যন্ত আমরা কেউ ধরিনি, কোনোদিন ধরবোও না।
মঞ্জুরুল ইসলাম/এমআরআর/এএসএম