ড. আকবর আলি খান একজন অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ এবং শিক্ষাবিদ। এছাড়া তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। সম্প্রতি তার সঙ্গে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। আজ থাকছে তার শেষ পর্ব।জাগো নিউজ : প্রধান বিচারপতি বলেছেন, অবসরে গিয়ে মামলার রায় লেখা ‘সংবিধান পরিপন্থী’। এ নিয়ে সংসদ, সংসদের বাইরেও বির্তক চলছে। বিষয়টি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন? ড. আকবর আলি খান : আমার কাছে মনে হয়, বিচারপতিদের তাদের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মামলার রায় লেখা উচিত। এরপরেও যদি অবসরে গিয়ে রায় লিখতে চান, তারও সময়সীমা থাকা উচিত। কেউ যদি অবসরে যাওয়ার ১০ বছর পরে রায় দেয়, তাহলে তো বাঞ্ছনীয় হলো না। সাংবিধানিক শপথের মধ্য থেকে তারা দায়িত্বে থাকেন। অবসরে গেলে সেই দায় অনেকটাই থাকে না। জাগো নিউজ : এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক... ড. আকবর আলি খান : আদালতের বিষয় রাজনৈতিক বিতর্কে সমাধান আসে না। আইনিভাবেই এর সমাধান হতে পারে। বিএনপি যদি মনে করে, যেসব রায় বিচারপতিরা অবসরে গিয়ে লিখেছেন, তা সিদ্ধ নয়, তাহলে তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। তখন আদালত কি সিদ্ধান্ত দেয়, তা থেকেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। জাগো নিউজ : মানুষের আস্থা-অনাস্থার প্রশ্নে এমন বিতর্ক কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে করেন?ড. আকবর আলি খান : বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এই বিতর্ক নিয়ে সবচেয়ে ভালো মূল্যায়ন করেছেন বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইতে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বিচার ব্যবস্থায় মিথ্যার মধ্য দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘মিথ্যা দিয়ে মামলা শুরু হয় এবং মিথ্যা দিয়ে মামলা শেষ হয়।’ জাগো নিউজ : এর জন্য প্রধানত কোন কারণটিকে উল্লেখ করবেন?ড. আকবর আলি খান : ব্রিটিশদের করা আইনেই এদেশের বিচার ব্যবস্থা, যা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। গলদ এখানেই। গোটা বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। এটি নিয়ে কেউ বিস্তর আলোচনা করছেন না। জাগো নিউজ : বিচারপতিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও তো অনেকে প্রশ্ন তুলছেন?ড. আকবর আলি খান : বিচারপতিদের নিয়োগে অসঙ্গতি সার্বিক সমস্যার একটি বিষয়। আরো অনেক বিষয় আছে। বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হলে মামলার নিষ্পত্তি বেড়ে যাবে। কিন্তু মামলার জট আরো বেড়ে গেছে। আবার এই পৃথকের ফলে পুলিশের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব হ্রাস পেয়েছে এবং পুলিশ এখন স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এতে করে পুলিশের কর্তৃত্ব নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনার বিষয় এসে গেছে। পরিবর্তন চাইলে বিচার বিভাগের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। জাগো নিউজ : ভাষার মাস। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন গণদাবি। আদালতের রায়, আইন সবই ইংরেজি ভাষায়। এটি কীভাবে দেখেন? ড. আকবর আলি খান : ভাষার মাস বলে কথা নয়, এটিকে আমাদের জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। রক্ত দিয়ে অর্জিত আমাদের বাংলা ভাষা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন সবাই চাই। আদালতের ভাষাও বাংলা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কিন্তু একদিনে এটি প্রচলন হতে পারে বলে আমি মনে করি না। বিচারকরা চাইলে এর জন্য একটি সময়সীমা বেঁধে দিতে পারেন এবং সেই সময় ধরে পরিবর্তন আনা উচিত। বিচার বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে, একটি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা। জাগো নিউজ : শুধু আদালত নয়, বাংলার প্রচলন নেই রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেও।ড. আকবর আলি খান : বাংলা ভাষার ব্যবহার না করা অত্যন্ত নিন্দনীয় বলে আমি মনে করি। তবে বাংলা ভাষার ব্যবহার না করার দুটি কারণ আছে। প্রথমত স্কুল-কলেজে বাংলা ভাষার যে মান তা অত্যন্ত নিম্ন। বাংলার শিক্ষকরাও ভালো বাংলা জানেন না।শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো খারাপ। সম্ভবত শিক্ষার্থীরা বাংলা বিষয়েই সবচেয়ে কম নম্বর পেয়ে থাকেন। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে এবং বাংলা ভাষার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত এটি হচ্ছে দায়ের ব্যাপার। সব বিষয়ই বাংলায় পড়ানো উচিত। কিন্তু বাংলায় ভালোমানের পাঠ্যপুস্তক করা কি এই মুহূর্তে সম্ভব? দক্ষ অনুবাদক-ই নেই। বিস্তর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেই বাংলা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। জাগো নিউজ : সার্বিক অর্থে শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রাষ্ট্র গঠনের সাড়ে চার দশক পরেও শিক্ষার মান নিয়ে অনেকে হতাশ। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? ড. আকবর আলি খান : শিক্ষার মান উন্নয়ন না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, এখানে মেধার সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। আমি সম্প্রতি একটি বই লিখেছি, যার বাংলায় শিরোনাম হচ্ছে, ‘খারাপ টাকা ভালো টাকাকে তাড়িয়ে দেয়।’ বাজারে যদি ভালো টাকা এবং খারাপ টাকা একসঙ্গে থাকে, তাহলে ভালো টাকা মানুষ ঘরে তুলে রাখে আর খারাপ টাকা বাজারে রাখে। বাংলাদেশে এই চিত্র এখন সমাজের সর্বত্রই। এখানে ভালো মানুষের মূল্যায়ন হয় না। খারাপ মানুষেরা সহজেই উপরে উঠে আসার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করলে শিক্ষার মান আপাতত ভালো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জাগো নিউজ : সত্যের জয় চিরন্তন। মন্দের কাছে ভালোর এমন হেরে যাওয়া কেন?ড. আকবর আলি খান : রাষ্ট্র বা সমাজের যে কাঠামো সেখানে ভালোদের কোনো মূল্যায়ন নেই। যেমন সরকারি কর্মকমিশনে এখন যে নিয়োগ সেখানে ভালোদের প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, সেখানে সঠিক মূল্যায়ন হয় না। এই ধরনের ব্যবস্থা পাশের দেশ ভারতে নেই। এমনকি পাকিস্তান আমলেও ছিল না। এখন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের যে মূল্যায়ন, তা খুবই খারাপ। এই ব্যবস্থা পরিবর্তন খুব জরুরি। আর রাষ্ট্রকেই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। জাগো নিউজ : সংকট উত্তরণে দায় তো সবার?ড. আকবর আলি খান : হ্যাঁ, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন বাংলা ভাষার প্রচলন হচ্ছে না, এর জন্য শুধু বাংলার শক্রদের দোষ দিলে হবে না। বাংলার মিত্ররাও এ ব্যাপারে সঠিক পরিশ্রম করছেন না। জাগো নিউজ : বাজার দখল হাজারো বইয়ে। লেখকদের লেখার মান নিয়েও কী বলবেন?ড. আকবর আলি খান : নিম্নমানের বই বাজার দখল করতে পারে না। হয়ত বিশেষ আইন দেখানোর জন্য এমন বই লেখা হয়। বিক্রিও হয়। কিন্তু বাজারে তার কোনো মূল্য নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবেশ দরকার। কিন্তু সেই পরিবেশ তৈরির কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না।জাগো নিউজ : ব্যস্ততার মাঝে মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য জাগো নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।ড. আকবর আলি খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।এএসএস/জেএইচ/এমএস