দেশজুড়ে

চাঁপাইনবাবগঞ্জে অস্তিত্ব সংকটে ফজলি আম

আন্দোলন করে ফজলি আমের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমজনতা। কিন্তু সেই ফজলিই এখন অস্তিত্ব সংকটে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। জিয়াই স্বীকৃত এই আমের গাছের জাত বদল করে অন্য আমচাষ বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন আমচাষিদের মাঝে সচেতনতা গড়ে না উঠলে ফজলি অলাভজনক অন্যান্য জাতের মতো হারিয়ে যাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।

আরও পড়ুন- গাছে গাছে আসছে মুকুল, পরিচর্যায় ব্যস্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা

কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তিন কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ফজলি জাতের আম। প্রথমত নতুন করে আর ফজলির বাগান গড়ে উঠছে না। দ্বিতীয়ত পুরোনো বিশাল বিশাল গাছের উৎপাদনক্ষমতা কমে গেছে। তৃতীয়ত সমতুল্য জাত আম্রপালির সঙ্গে বাজারমূল্যের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে ফজলি আম।

শিবগঞ্জ উপজেলার সুজা আলী বলেন, আগের জনপ্রিয় ফজলি জাতটি প্রথম বাণিজ্যিক ধাক্কা খায় কয়েক বছর আগে। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে কেবল আম্রপালি জাতের সম্প্রসারণ শুরু হয়। আম্রপালি আম পাকে ফজলির সময়ই। আকার ও স্বাদে আকর্ষণীয় হওয়ায় আমপ্রেমীরা ফজলির বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেন আম্রপালিকে। এতেই কমে যায় ফজলি আমের কদর।

চাষিরা বলছেন, কদর কমায় ফজলি আমের দামও কমেছে। মাত্র তিন বছর আগে যে ফজলি আম বিক্রি হয়েছে ৪-৫ হাজার টাকা মণ দরে। গত দুই বছর থেকে বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার টাকা মণ দরে। এতে লোকশানে পড়তে হচ্ছে চাষিদের। তাই ফজলি আমের গাছ কেটে কাটিমন জাতের আম বাগান তৈরি করছেন তারা।

শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম বলেন, জেলায় প্রতি বছর আমবাগান বাড়লেও নতুন করে কেউ আর ফজলির বাগান গড়ে তুলছেন না। অথচ গত এক দশকে বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে নিয়েছে আম্রপালি, কাটিমনসহ বিভিন্ন জাতের আম। পুরনো যে ফজলির বাগানগুলো রয়েছে সেগুলোও হারিয়েছে উৎপাদনক্ষমতা। সব মিলিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেই যাচ্ছে জাতটি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর ফজলি আমের চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমিতে। গাছের সংখ্যা ৫ লাখ ৯১ হাজার। গত কয়েক বছরে ফজলি জাতের কী পরিমাণ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে তার পরিসংখ্যান নেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে। তবে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বড় বড় গাছ কেটে ফেলার ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি আম গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে শিবগঞ্জ উপজেলায়। এই উপজেলাতেই ফজলির বাগান বেশি। সম্প্রতি শিবগঞ্জের শেখটোলা গ্রামে সাড়ে ১৬ বিঘা আয়তনের একটি ফজলি বাগান কেটে ফেলতে দেখা গেছে।

আরও পড়ুন- চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম বোর্ড গঠনের দাবি

স্থানীয়রা জানান, এই বাগানের একেকটি গাছের বয়স দেড়শ’ বছরের কম নয়। ধাইনগর, শাহবাজপুর, হাজারবিঘী, তেলকুপি এলাকাতেও বাগানের বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বাগান মালিকরা বলছেন ৪-৫ বছর আগে থেকে বাগান কাটা শুরু হলেও গত দুই বছরে দেদারসে কাটা হচ্ছে গাছ।

কেন কাটা হচ্ছে আমগাছ

আমচাষিরা বলছেন বড় গাছগুলো থেকে আগের মতো আর আম পাওয়া যাচ্ছে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনক্ষমতা হারিয়েছে গাছগুলো। উৎপাদন কমে যাওয়ায় হতাশা থেকেই কেটে ফেলা হচ্ছে বাগান।

শিবগঞ্জের শেখটোলা গ্রামের আব্দুল জলিল ও সমশের আলী বলেন, ফজলি গাছে আমের উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়াও বড় গাছ হওয়ায় পরিচর্যা করতে সমস্যা হচ্ছে বাগানীদের। তাই জেলার আম বাণিজ্যের জন্য অশনী সংকেত হলেও চাষিরা সাময়িক লাভের কথা চিন্তা করে উজাড় করছেন বাগান।

রফিক নামে এক ব্যক্তি বলেন, ভারত থেকে আসা অবৈধ হরমোন ‘কালটার’ অতিরিক্ত মাত্রায় প্রয়োগে ফজলি আম গাছের ক্ষতি হয়েছে। অনেক গাছের কাণ্ড পচে গেছে। তাই কোনো কোনো বাগানে বাধ্য হয়েই কেটে ফেলতে হচ্ছে আম গাছ। বড় গাছে হরমোনের অতিরিক্ত প্রয়োগ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন চাষিরা।

তবে বড় গাছগুলোর উৎপাদনক্ষমতা হারিয়েছে চাষিদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক।

তিনি বলেন, বড় গাছ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সম্পদ। যে হারে বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে আমচাষিদের হা-হুতাশ করতে হবে।

তিনি বলেন, একটি বড় গাছ কম জায়গায় অনেক বেশি আম উৎপাদন করে। বড় গাছের সমপরিমাণ জায়গায় ছোট গাছ লাগিয়ে সেই পরিমাণ আম পাওয়া সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন- ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতিতে সোনামসজিদ স্থলবন্দর

তিনি আরও বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। চাষিরা যাতে গাছ কেটে না ফেলেন সে ব্যাপারে তাদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি চাষিরা তাদের উৎপাদিত আমের সঠিক মূল্য যেন পান তা নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার বলেন, চাষিরা এখন আল্ট্রা হাইডেনসিটি (অতি ঘন) বাগানের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি গত এক দশকে ছোট গাছের জাতগুলোর সম্প্রসারণ হয়েছে জেলায়। চাষিরা যখন কোনো নতুন প্রযুক্তি পান তখন পুরোনো প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এটাই বাস্তবতা।

তার ভাষ্য, কৃষি বিভাগ চাষিদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যাতে তারা বড় গাছগুলো দেদারসে না কাটেন। অনেক চাষি বড় গাছ কেটে ফেলে সেখানে অন্য ফসল চাষ শুরু করেছিলেন, তাদের আবারও আমচাষে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ।

তিনি আরও বলেন, বড় গাছ কেটে ফেললে জীববৈচিত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এলাকার তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। এতে শুধু আম নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্যান্য ফসলও।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, আমের নতুন নতুন জাত পুরনো জাতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। তবে বড় বাগান কেটে ফেলে নতুন জাত সম্প্রসারণ করা ঠিক হবে না। চাষিরা এখন আগাম ও নাবী জাতের আমচাষে ঝুঁকছেন। আমের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচিত জুন মাসে যেসব আম পাকে সেগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন চাষিরা। অতিরিক্ত লাভের আশায় এটা করেছেন তারা। কিন্তু এটা মোটেও উচিত নয়। ফজলি জাতের আমও গাছ ছোট রেখে চাষ করা সম্ভব।

এফএ/এএসএম